সহধর্মিনী
রোড এক্সিডেন্টে আমার স্বামী ফায়াজের ডান পা প্যারালাইজড হয়ে যায়। অফিস থেকে ফেরার পথে বাইকের সাথে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে এই দূর্ঘটনাটার সম্মুখীন হয় ফায়াজ।
তারপর থেকেই শুরু হয় আমাদের জীবনের কঠিনতম দিনগুলি। ছোট ছোট দুইটা ছেলে মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় বসার মতো অবস্থা হয়। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে শ্বশুর-শাশুড়ি পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলো আমাদের থেকে।
ফায়াজের অফিস থেকে প্রথম অপারেশনের সমস্ত টাকা তারাই বহন করে। কিন্তু তাতে পায়ের কোনো উন্নতি না দেখে ফায়াজের জমানো টাকা থেকে অন্যজায়গায় অপারেশন করানো হয়। দ্বিতীয়বারের মতো ব্যর্থ হলে পরিবারসহ সকলেই আশা ছেড়ে দেয়। এমনকি ফায়াজ নিজেও বলে ওর পা আর কোনোদিনো ঠিক হওয়ার নয়। এক্সিডেন্টে ফায়াজের পা টা খুব খারাপ ভাবে ভেঙ্গে যায়। প্রথমবার অপারেশনে হাঁটু কিছুটা নড়াচড়া করাতে পারলেও দ্বিতীয়বারে সেটা একদম অবস হয়ে যায়। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে ওর পা প্রচন্ড আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারনে অনেক জটিলতার সম্মুখীন হয়েছে। তাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বুঝতে পারি সবথেকে ভালো অপারেশনের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন।
পরিবার আত্মীয় স্বজন মুখের উপর 'না' না করলেও ঘুড়িয়ে পেছিয়ে একটা কথাই বলেছিলো ফায়াজের পা ঠিক হবে না কোনোদিন। মুখ বুজে তাদের টাকা ধার না দেওয়ার অযুহাতগুলো শুনে এসেছিলাম।
সকলের এমন তিক্ত কথা আর দিনশেষে হাজার হাজার টাকার ঔষধ সবমিলিয়ে আমি অসহায়ত্ব অনুভব করছিলাম। এদিকে মা বাবা তাদের খরচের টাকা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে হাজার পাঁচেকের মতো টাকা দিয়েছিলো আমার হাতে। বাধ্য হয়ে নিতে হয়েছিলো দুটো বাচ্চার খরচের কথা চিন্তা করে। কারণ ভাবীরা জানতে পারলে কখনোই দিতে দিতো না।
এখনো মনে পড়ে আমার বড় ভাবী সেদিন আমায় এমন করুণ অবস্থায় কাঁদতে দেখেও মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলো,
-কি রে সনি এখনও কি এই খোরা জামাই নিয়াই জীবন কাটাবি? কত বড় বড় বাচ্চা রাইখা আজকালকার মাইয়ারা বিয়া করে। আর তোরতো একটা তিন বছর আর একটা সাত বছরের পোলা-মাইয়া। ওদের রাইখা বিয়া করলে এমন কিছুই হইবো না।
কথাটা শুনে তখন আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু আমি পারিনি, আমি শুধু মুখে আঁচল গুজে দৌঁড়ে এমন কটু কথা থেকে বাঁচতে পালিয়ে ছিলাম। সেই যে বাবার বাড়ি ছেড়ে ছিলাম আর কোনোদিন যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।
.
ফায়াজের সাথে আমার বিয়েটা যদিওবা প্রস্তাবেই হয়েছিলো। কিন্তু মানুষটার প্রতি আমার টান, মায়া ভালোবাসাটা এতটাই গভীর ছিলো যে হাজার বছরের সম্পর্কেও বুঝি এত ভালোবাসা থাকে না। ওর সামান্য জ্বর হলেও আমি সারারাত জেগে সেবা করতাম। একবার অফিসের ঝামেলা নিয়ে ফায়াজের মন খারাপ ছিলো। ঠিক তখনই আমার শাশুড়ির চোখ অপারেশন করা হয়। সেদিন মা'কে অপারেশন কেবিনে ঢোকানোর সময় প্রথম দেখেছিলাম ফায়াজের চোখে এতো অশ্রু।
পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না তবে তাদের ভেতরে যে কান্নার বদলে রক্তখরণ হয় সেটা খালি চোখে থাকা মানুষগুলো দেখতে পায় না। আমি তখন ফায়াজের হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলেছিলাম,'ভয় পেয়ো না আল্লাহ তায়ালা সব ঠিক করে দেবেন'। সত্যি বলতে ও'কে ওই অবস্থায় দেখে আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো। আর সেই মানুষটাকে এই অবস্থায় ছেড়ে বাঁচার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও দেখতে চাই না।
ফায়াজরা তিন ভাই। ফায়াজই ছিলো সবার ছোট ছেলে। আমার শ্বশুর শাশুড়ি তিন ছেলেকে সমান ভালোবাসলেও তাদের বরাবরের মতোই নালিশ ছিলো ফায়াজ'কে বাবা মা বেশি ভালোবাসে। এমনকি এই দুর্দিনেও তারা কথা শোনাতে ছাড়েনি।
হাজার টাকার ঔষধ-পাতির খরচা বড় ভাবী আর ভাইয়াকে দিতে দেবেন না। কথাটা সরাসরি না বললেও আমি সেদিন রান্নাঘর থেকে ফায়াজের জন্য দুধ গরম করে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখনিই বড় ভাইয়ার রুম থেকে ভাবীর কথাগুলো স্পষ্ট আমার কানে ভেসে আসে,
-তোমার ভাইতো জীবনেও ঠিক হতে পারবে না। দু দুবার অপারেশন করা হলো তাতে কোনো লাভ হয়েছে? আর তুমি কোন আশায় রোজ রোজ এতো টাকার ঔষধ এনে দিচ্ছো হ্যা? বলি আমাদের কি সংসার হাওয়ায় চলবে?
--আহ কি হচ্ছেটা কি? সোনিয়া শুনতে পাবেতো নাকি? ফায়াজতো আমার ভাই হয়। ওকে এই দুর্দিনে কোথায় ফেলে দেবো আমরা বলো?
-কেন ওর ভাগের সম্পত্তি টুকু তোমার বাবাকে বলে দিয়ে দিলেইতো হয়ে যায়। আর যে ভাবে পঙ্গু হইছে মনে হয় না আর কোনোদিন ঠিক হবার। শুধু শুধুই টাকা পয়সাগুলো নষ্ট।
কথাগুলো শুনে আমি আর একমুহূর্তও দাঁড়াতে পারিনি। এক দৌঁড়ে আমার রুমে এসে দুধের গ্লাসটা রেখে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে কাঁদতে থাকি। ফায়াজ ছিলো আমার হৃৎস্পন্দন, কিভাবে যেন সবটা বুঝে যেত ও না বলাতেই। অসহায় মানুষের মতো ফায়াজ হুইলচেয়ারে বসে নিরবে চোখের জল ফেলতো। আমার সাত বছরের ছেলেটা তখন ফায়াজের গলা জড়িয়ে ধরে বলতো, 'বাবাই তুমি কেঁদো না আমার গড তোমার পা একদম ঠিক করে দেবে'।
ফায়াজ তখন শুধু অবুঝ বাচ্চাদের মতো নিরবে চোখের পানি ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
আমার তিন বছরের বাচ্চা মেয়েটার দুধের কৌটা কেনার মতোও সামর্থ্য ছিলো না তখন ওর। এটা বলেই ও ডুকরে কেঁদে উঠতো।
আর আমার কথাতো ফায়াজ বলতেই পারতো না। ওর গলার স্বরটা ভারি হয়ে আসতো।
.
ছেলের স্কুলের বেতন বাকি থাকায় স্কুল থেকে নোটিশ পাঠিয়েছিলো। ফায়াজের মাস শেষে দেওয়া হাত খরচের কিছু টাকা ছিলো আমার কাছে। সেই টাকাগুলো ছেলের কাছে বকেয়া বেতনের জন্য পাঠিয়ে সেদিন থেকেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
আমার শ্বশুর শাশুড়ি চুরি করে নিজেদের খাবার থেকে মাছ, মাংস আমার ছেলে মেয়ের জন্য তুলে রাখতো। কিন্তু একদিন মেজো ভাবী এসে মুখের উপর বলেই দিলেন,
-আম্মা আপনার ছোট ছেলেটা যে পঙ্গু হয়েছে তবুও আপনাদের তার প্রতি চুরি করা ভালোবাসা গেলো না। এখন আবার ওর বাচ্চাগুলারেও চুরি কইরা খাওয়ানো শুরু করছেন?
আমার ছেলেটা সেদিন কাঁদতে কাঁদতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, 'আম্মু এখানে সবাই পঁচা চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যায়'। চোখের জল ছাড়া ছেলেকে উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ভাষা ছিলো না আমার। সত্যিইতো এখানে আমরা সবার বোঝা, যার স্বামীর রোজগার নেই সে কেন আর অন্যের বোঝা হয়ে পড়ে থাকবে? তাই ঠিক করলাম এ বাড়ি থেকে চলে যাবো।
পরদিন সকালেই শ্বশুর শাশুড়ির দোয়া নিয়ে শ্বশুর বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। মা বাবা ফায়াজকে আর আমার ছেলে মেয়ে দুটোকে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেছিলো। কিন্তু তাদের যে আটকানোর মতো ক্ষমতা ছিলো না আর। তারা নিজেরাইতো এ বাড়ির ছেলে বউদের কাছে বোঝা। সেখানে আমরা চারটা পেট আরো বোঝা সৃষ্টি করে শুধু শুধু অশান্তির কারণ। কোনোমতে বাবা মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম।
কম টাকার মধ্যে কোনোরকম থাকার মতো একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। ফজর ওয়াক্তে উঠে নামাজ কালাম আদায় করে ফায়াজকে সহ বাচ্চাদের খাওয়ানো শেষ করে বোরকাটা গায়ে জড়িয়ে সার্টিফিকেট হাতে বেড়িয়ে পরতাম কিন্ডারগার্টেনের উদ্দেশ্য। কিন্তু কোনো স্কুলেই ক্লাস, কোচিং দিয়েও তেমন বেতন আসবে না। বাধ্য হয়ে কিন্ডারগার্টেনের আশাটাও ছেড়ে দিলাম। কাছে থাকার মতো শেষ সম্বলটুকু ছিলো বিয়ের গয়নাগুলো। মেয়েটার বিয়ের কথা ভেবে ওগুলো রেখেছিলাম। কিন্তু যদি আমার স্বামীকেই না সুস্থ করতে পারি তাহলে সন্তানের ভবিষ্যত ভেবে আর কি করবো?
গয়নাগুলো বিক্রি করে যে টাকা এসেছিলো তাতেও ফায়াজের উন্নত অপারেশন হতো না। তাই ঠিক করলাম ব্যবসা শুরু করবো। প্রথম অবস্থায় মেয়েদের থ্রি-পিছসহ সকল প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাসায় এনে বিক্রি করতে শুরু করলাম। তারপর মোটামুটি আয় হলে চিন্তা করলাম অনলাইনে বিক্রি করবো। পরিচিত এক বান্ধবী কর্মরত থাকা ব্যাংক থেকে কিছু টাকা লোন নিয়ে অনলাইন ব্যবসা শুরু করলাম। মাস শেষে মোটামুটি ভালোই আয় হতো।
ফায়াজের অপারেশনের জন্য টাকা জমানো শুরু করলাম। ছেলেকে আবার স্কুলে পাঠালাম। ফায়াজ প্রথম প্রথম হুইলচেয়ারে বসেই হিসাব নিকাশের সব কাজ করতো। দেখতে দেখতে দুর্দিন কিছুটা কাটিয়ে উঠলাম।
প্রতীক্ষিত সেই দিনে আমার স্বামী ফায়াজের অপারেশন করা হলো। আল্লাহ তায়ালার রহমতে আমার স্বামী সুস্থ হলো। অপারেশনের পর প্রথম যখন আমার ফায়াজ উঠে দাঁড়ায় আমি তখন বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। আমি সেদিন জিতেছিলাম! হ্যা হারতে হারতে হাল না ছেড়ে জিতে গিয়েছিলাম। মনে সাহস আর সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখেছিলাম।
একটা মেয়ের জন্য এতগুলো ধাপ পেরিয়ে আসা মোটেও সহজ ছিলো না। নিজের বাবা মা ও বলেছিলো,
ফায়াজ কে ছেড়ে দে।
শ্বশুর শাশুড়ি বলতে বাধ্য হয়েছিলো,
আমার ছেলের আশাটা ছেড়ে দাও বউমা।
পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সকলের মুখে একটা কথাই ফায়াজ পঙ্গু, ও আর কোনোদিন ঠিক হবে না। শুধু আমার বিশ্বাস ছিলো আমার স্বামী একদিন সুস্থ হবেই। সেই বিশ্বাসের জোড়ে এতদূর এসেছি আমি।
.
আলহামদুলিল্লাহ আমরা এখন সব ফিরে পেয়েছি। ফায়াজ সুস্থ হয়েই আবার ওর অফিসে জয়েন করেছে। আমার অনলাইন ব্যবসাটাও অনেক বড় হয়েছে। যেই আত্মীয়-স্বজন মুখ ঘুড়িয়ে নিয়েছিলো আজ তারাই বাহবা দেয়।
গাড়িতে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়েছে খেয়ালই করিনি। ফায়াজ সিটে রাখা আমার ডান হাতটার ওপর ওর বাম হাতটা রেখে বললো,
-আজও কি কাঁদবে?
আমি ওর কাধে মাথাটা রেখে বললাম,
-কাঁদতে দাও একটু, আজকের অশ্রুটা যে সুখের অশ্রু।
দীর্ঘ পাঁচটা বছর পর আজ আবার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি। সেখানে থাকার উদ্দেশ্যে নয় শ্বশুর শাশুড়িকে নিজেদের সাথে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে। ওখান থেকে ফিরে আসার পথে আমার বাবা মা কেও দেখে আসবো। ফায়াজের সুস্থ হওয়ার খবরটা শোনার পর নাকি ভাইয়া ভাবীরাও ফায়াজকে দেখতে চেয়েছে।
ফায়াজ অবশ্য কারো সাথেই দেখা করতে চায়নি। কিন্তু আমিই ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসলাম। আমি মনে করি যে যাই করুক আমরাতো পারি না তাদের সাথে তেমন করতে তাইনা? তাহলে তাদের সাথে আমাদেরও যে তফাত থাকবে না।
কিছুদূর যেতেই ফোনটা মেসেজের শব্দে কেঁপে উঠলো। আমি আনলক করে মেসেজটা ক্লিক করতেই দেখলাম ফায়াজের নাম্বার থেকে আসা। ফোনটার দিকে তাকিয়ে আর মাথাটা উঁচু করতে পারলাম না। মেসেজটাতে লেখা ছিলো,
"আজ শুধু একটা কথায় বার বার মনে হয়, সহধর্মিনী হওয়া বুঝি অতোটাও সহজ নয়। প্রিয়মুখগুলোওতো সেদিন পঙ্গু স্বামীকে ছেড়ে নতুন করে বাঁচতে বলেছিলো তোমায়। কিন্তু তুমি যাওনি, তুমি আমায় একা ফেলে চলে যাওনি সুখী জীবনের খোঁজে। সহধর্মিনী মানে শুধু সুখের সাথীই নয়। দুঃখের সময়ও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকার নামই সহধর্মিনী। ভালোবাসি তোমায় যার পরিমাপটা প্রকাশ করার মতো নয় কোনোদিন"।
আমি মেসেজটা দেখে চোখ তুলে আর তাকাতে পারিনি ফায়াজের দিকে। বোবাকান্নায় চেয়ে আছি অপলক ফোনটার স্ক্রিনে। আমার ছেলে মেয়ে দুটো ওর বাবার পাশের সিট থেকে উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বোরকার আড়ালে ভেজা চোখ দুটোর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফায়াজ আমাদের পুরো পরিবারটা কে জড়িয়ে রাখলো ওর বাহুডোরে।
Comments
Post a Comment
Thank you, Stay connected & subscribe to this blog...