ধসা বামুন
পাঁচকড়ি মিশ্রকে লোকে কডে বামুন বলত । ওর অনেক বিষয় সম্পত্তি । অনেক জজমান আর অনেক শিষ্য । পুরো পায়রাটাঙ্গী জুড়েই তার জজমান ।তা প্রায় ২০০/৩০০ ঘর । আর ছিল আকব্বরী খালের ধারে বিঘা বিঘা উর্বর জমি ।
ভুতোদাদুরা পাঁচভাই কোডে বামুনের জমিগুলি চাষ করত । তারা যখন পৃথক হ’ল, জমিগুলো তেমন আর চাষবাস করতে পারত না । কডে বামুন ভুতোদাদুদের ছাডিয়ে, শেতল মোড়লদের চাষ করতে দিল । শেতল মোড়লরা আট ভাই তখন একান্নবর্তি পরিবার । দিনরাত জমিতে খেটে, সোনার ফসল ফলায় । আমার বন্ধু খেপা আর বুধো মোড়ল ছিল শেতল মোড়লের ভাইপো । তারা বাপ-কাকাদের জন্য মাঠে জলখাবার নিয়ে আসত ।
পাঁচকড়ি মিশ্র যখন হরিণের চামড়ার জুতো পরে আর সৌখিন ছড়ি দোলাতে দোলাতে মাঠে ফসল দেখতে বেরোত, লোকে বলত, “কড়েবামুনের মন মেজাজ সব সময় ফুরফুরে !”
পাঁচকড়ির তিন ছেলে । বড়টির নাম ধসা । ভালো নাম গঙ্গাধর মিশ্র । ছেলেমেয়েদের মুখে বাপের মুখের ছাপ ।
বর্ণপরিচয়ে “হ” এ হরিণ পড়ানোর সময় মাস্টার মশাই ভোলানাথ চক্রবর্তী বলতেন, “ধসা, হরিণ দেখেছিস ?”
ধসা বলত, “না, মাস্টার মশাই !”
⁃ “তোর বাপের জুতো হরিণের চামড়ায় তৈরী । তোকেও একটা কিনে দিতে বলবি !”
⁃ “বাবাকে বলেছি তো ! বাবা বলেছে, পৈতে না হ’লে পরতে নেই !”
হরিণের চামড়ার জুতো পরার লোভেই হো’ক বা যে কোন কারণেই হো’ক, ধসার খুব তাড়াতাড়ি পৈতে হয়ে গেল । তিনটে পিরিয়ডের ঘন্টা পড়লেই আমাদের একসঙ্গে জোর টয়লেট পেয়ে যেত । দল বেঁধে বেরোতাম । ধসা আর বোঁচা টুক করে কানে পৈতেটা জডিয়ে নিত । আমাদের বেশ মজা লাগত আর এনিয়ে খুব পিছনে লাগতাম ।
খেপার টানাটানিতে একদিন ধসার পৈতে গেল পুটুস করে ছিঁডে ।
ধসা বলল, “আমার কিছু হ’বে না । তোর পাপ হ’বে !”
খেপা বলল, “তাহলে উপায় ?”
মাস্টার মশাই, ভোলানাথবাবু বিধান দিলেন, “ব্রাহ্মণভোজন করাতে হ’বে ! যা তোর ঠাকুরমাকে বলে দিস । তবে এখনকার মতো এই পিতলের গ্লাসে করে চট করে বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে আয় । চা খাব !”
খেপার ঠাকুরমা নাতি অন্ত প্রাণ । গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে হাউমাউ করে ছুটে এলো । ভোলানাথবাবু আর গোবিন্দবাবু (গোবিন্দ পদ ভট্টাচার্য ) বললেন, “ ছোট শিশুরা খেলার ছলে কি না কি করেছে, তাতে এত চিন্তার কি আছে !”
খেপার ঠাকুরমা বলল, “তাহলে ব্রাহ্মণভোজন ?”
ভোলানাথবাবু বললেন, “ সেটা তুমি আয়োচন করতে পার । আমি আর গোবিন্দদা তো আছিই । পাঁচকডিকেও বলে দেব ।”
গোবিন্দবাবু বললেন, “ধসা, বোঁচাও যাবে । পাঁচটা বামুন তো হয়েই গেল !”
খেপার ঠাকুরমা মানে শেতল মোড়লের মা, সেই সঙ্গে আর তিন জন শিক্ষকদেরও মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ করে দিল । আমি আর শঙ্করও বিসমিল্লার পোঁ হয়ে খেপা-বুধোদের বাড়িতে বাহ্মণভোজনের পেসাদ পেলাম ।
খেপার ঠাকুরমা আয়োজনের কোন ত্রুটি রাখেনি । নাক উঁচু কডে বামুনও নিন্দে করার কোন খুঁত খুঁজে পেল না । তাই মাঝের জমিতে আলু গাছ তেমন লাগলনা কেন সেই নিয়ে খেপার মেজো জ্যেঠা, বুধোর বাবা, বিষ্টু মোড়লের সঙ্গে আলোচনা শুরু করল ।
বিষ্টু মোড়ল বলল, “আরেকটা তলা সেজ পড়লেই , এর রূপ দেখতে পাবে দাদাঠাকুর ! এই তো সবে মাটি হ’ল ।”
কডে বামুন বলল, “তাই হয়ত হ’বে !”
খেপা টুয়ে, বুধো থ্রিতে ফেল করে এক বছর করে পিছিয়ে পড়ল । শঙ্কর, ধসা, বোঁচা আর আমি ফোরে উঠলাম । সেই উপলক্ষে ধসা পেল একদম নতুন উয়িংসন পেন । পড়াশুনায় স্বাধারন হলেও ধসার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর । ওর বাবার হাতের লেখাও নাকি একদম মুক্তর মতো ।
সেযুগে আমার বাবার একটা এই পেন ছিল । বাবা খুব যত্ন করে ব্যবহার করতেন । আমাদের ছুঁতেও দিতেন না । আমি যখন জলপাইগুডিতে ইন্জিনিয়ারিং পড়তে গেলাম, বাবা ওই পেনটা আমাকে দিয়েছিলেন । আমি সেটা পুরো কলেজ জীবন ব্যবহার করেছিলাম ।
তবে ধসার সে পেন ওর থেকে আমি আর শঙ্করই বেশি ব্যবহার করতাম । ধসা পার্ট পার্ট করে খুলে দিন তিনেকের মধ্যেই সেটার চোদ্দটা বাজিয়ে ছাড়ল । কডে বামুন আরেকটা কিনে দিল । এটা ধসা বেশ কিছু দিন অক্ষত রেখেছিল ।
আমরা বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে হাই স্কুলে ভর্তি হলাম । ধসা আরেকটা উয়িংসন পেন পেল । নতুন পুরানো ভাঙা, আধা ভাঙা এবং অক্ষত মিলিয়ে ধসার নতুন ইন্জিনিয়ারিং শুরু হ’ল । এটার নীব ওটার রবার টিউব । এই ইন্জিয়ারিঙে ধসার চেলা কুমোরদের বীরেন পাল । পরবর্তি কয়েক বছর দু’জনেই একই ক্লাসে এই পরীক্ষা নিরীক্ষা জারি রেখেছিল । তাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমে ক্ষীয়মান । ইতি মধ্যে হাই স্কুলে পাঁচ মায়ের পাঁচ সন্তানদের সাহচর্যে ধসার বাক পটুত্বে সিদ্ধিলাভ হ’ল । বীরেন সহ তার অনেক চেলা ।
অত:পর বীরেন সতীশ সাঁতরার দোকানে সাইকেল সারানো শিখে স্কুলধারে দোকান দিয়ে তার ইন্জিনিয়ারিং এখনও জারি রেখেছে । আমাদের ওখানকার প্রায় সব সাইকেল ইন্জিনিয়ারই অবশ্য সতীশ ইউনিভার্সিটি প্রক্তনী ।
ধসাকে দেখতাম পোঁপোঁ করে সাইকেল নিয়ে পায়রাটাঙ্গীতে পূজো করতে যেতে ।
হাই স্কুলে ফাইভে ভর্তি হয়েই আমাদের প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুদের ডেকে বাঁধের ধারে কামারের মিস্টির দোকানে, শাল পাতার ঠোঙায় একটা একটা করে দানাদার ধরিয়ে বলল, “ আজ থেকে আমাকে আর ধসা বলবি না । গঙ্গা বলবি !”
শঙ্কর বলল, “উঁহু একটাতে হবে না । আরও দু’টো করে দিতে হ’বে !”
অবশেষে অনেক নেগোসিয়েশনের পর আরো একটা করে রফা হ’ল ।
বোঁচা বলল, “ আমাকেও আর বোঁচা নয়, শ্রীমন্ত বলবি !”
তবে তার সঙ্গ রফা হয়েছিল পূজো করে ফেরার পথে কলা দিয়ে । কারণ তার নাকি নগদ পয়সা নেই !
বিবেক প্রধানদের বাড়ির পর একটা ফাঁকা মাঠে ছিল একটা নির্বান্ধব আমলকি গাছ । এটা বামুনদের নাকি জাতক গাছ ছিল । তাই ঢিল ছোঁড়া মানা । ধসার সঙ্গে ঢিল মেরে আমলকি পেড়েছি কত বার ! ও তো বামুন । তাই ওর ঢিল মারলে পাপ লাগে না । আমরা ওর হাতে ঢিলের জোগান দিতাম । তবে টক টক কষাটে আমলকি আমার একদম ভালো লাগত না ।
ধসা বলত, “এতে নাকি খুব উপকার !”
এখান থেকেই শুরু হ’ত বামুন পাড়া । একটা উঁচু বেদীতে শিতলা-মনসার বড় বড় ঘট । তিন চার ঘর ভট্টাচার্য । ভট্টাচার্যরা বরাবরই টোল চতুষ্পাঠীর গুরু ছিল । তাই বাড়ি বাড়ি পূজো করত না । মানে যজমান ছিল না । আমাদের মাস্টার মশাই গোবিন্দবাবুর বাড়ি এখানেই । ওনি ব্যাতিক্রম করে আমাদের বাড়ি পূজো করতেন । সে আরেক গল্প ।
গোবিন্দবাবুর বাবার পাটশালায় বাবা পড়েছিলেন । সেখানে গোবিন্দবাবু এবং ভোলানাথবাবুও মাঝে মাঝে পড়াতেন । তাই বাবা দুই সহকর্মীকেই মাস্টার মশাই বলতেন এবং পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন ।
একটা বড় পুকুরের পাড়ে ছিল মেঘনাদ ভট্টাচার্য্যের চতুষ্পাঠী । লোকে বলত “চৌপাঠী” । চতুষ্পাঠীটি কালের গর্ভে বিলিন হলেও পুকুর বা দীঘিটা এখনও “চৌপাঠির দীঘি “ বলে রয়ে গেছে । আর রয়ে গেছে তার পাড়ে হাডি পাড়া । আগে তারা ধাইমার কাজ করত । এখন চুল্লু বানায় ।
ভট্টাচার্য্যদের বাড়ির পর ছিল চক্রবর্তিদের অনেকগুলি বাড়ি । আমাদের মাস্টার মশাই ভোলানাথবাবু এবং তস্য পুত্র বোঁচা মানে শ্রীমন্তদের বাড়িও ওখানে । চক্রবর্তিদের পাড়ায় পাডায় জজমান । ভোলানাথবাবু, বোঁচা আর বোঁচার এক ভাগ্নে, পল্টু, মিলে পূজো করে শেষ করতে পারত না ।
চক্রবর্তিদের বাড়ির পর অনেকগুলো পোডো মন্দির । এই মন্দির চত্তরে হ’ত বাসন্তীপূজো । চত্তরের উত্তর-পূর্ব কোনে ছিল ধসাদের বাড়ি । তারপর একটা ধর্ম মন্দির এবং বাগ্দীপাডা ।
বাসন্তীপূজোর সময় বামুনপাডার ছেলেদের কাছে ধোসার ছিল হেব্বী ডিমান্ড । ওর বাবা ওকে প্রতিদিন তিন টাকা করে দিত । আমরা কোনদিন চারানা মানে একটা গোল চাকতির মতো, পঁচিশ পয়সা কিংবা পদ্ম ছাপ পিতলের কুড়ি পয়সা পেলেই হাতে স্বর্গ পেতাম । সেখানে কডকডে তি-ন টাকা !
ধসার পয়সায় কার্বাইড কিনে ডিপে বোম্ব তৈরী হ’ত । একটা ছোট আমুলের কৌটোর ঢাকনা খুলে, তাতে ছোট এক টুগরো কার্বাইড দিয়ে থু করে একটু থুতু দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করতে হ’বে । ডিপের নিচে কাঁটা পেরেক দিয়ে একটা সরু ফুটো করা আছে । সেই ফুটোটা বাতির উপর ধরলেই, দুম করে শব্দ হয়ে ডিপে দু তিন ফুট উপরে উঠে যেত । সে এক ভীষণ আমোদ । লঙ্কা বোম্ব, চকলেট বোম্ব, টোটা বন্দুকের চেয়েও মজা ! আর এসবের মধ্যমনি তখন ধসা ।
গোবিন্দবাবুর বড় ছেলে, অমরদা তখন আমাদের গ্রামের একমাত্র ডাক্তার । তারকেশ্বরের ডাক্তার সূর্য ভৌমিকের কম্পাউডার ছিল অনেক দিন । এখন সে ইউনিভার্সিটির পর, নিজেই প্র্যাক্টিস শুরু করেছে ।
হ্যামার ব্র্যান্ড মানে হাঁতুড়ে হ’লে কি হ’বে ? চিকিত্সা কিন্তু ভালোই করত । আর ভালো মন্দ যাই হো’ক, নাই দেশে একমাত্র ভেরেন্ডা বৃক্ষ তখন অমরদাই । লোকে বলত উনি নাকি গর্ভপাতের ধণ্বতরী । গর্ভপাত জিনিসটা কি, তখনও বোঝার বয়স হয়নি ।
আমলকি গাছের বাঁ দিকে খোলার চালের চেম্বার । সেখানে লাল লাল বিদ্ঘুটে মিক্সচার বানিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া কাঁচের শিশিতে কাগজ সেঁটে দাগ কেটে দেয় । খাবার পর এক দাগ করে কারে ঢেলে ঘুট করে গিলে নিতে হ’বে । খেলেই অন্ন প্রশাসনের ভাত পর্যন্ত উঠে আসে । অমলদা তখন দু’হাতে রোজগার করে ।
কিন্তু একপয়সাও সংসারে দেয় না । টাকা পয়সা যে জমায় তাও কিন্তু না । সংসার চলে শিক্ষক গোবিন্দবাবুর মাইনের স্বল্প আয়ে ।
এ হেন অমরদার ডাক্তারখানার পিছনে, গোবিন্দবাবুর পরিত্যক্ত কূয়ার ধারে, বিস্তৃন্য ভূখন্ডে তাঁরই পরিচালনায় শুরু হ’ল তিন রজনী ব্যাপি বিরাট যাত্রা অনুষ্ঠান । অচিরেই ধসা গেল জুটে সেই দলে । দুলাল শাসমলের সঙ্গে সেও কমিডিয়ান । তার বাক পটুত্বে পড়ল সুন্দর পালিশ ।
অমরদার প্রসার যত বাডতে লাগল, বদ্বন্ধু সমাগমও । তাদের সহচার্য্যে অমরদার সঙ্গে ধসারও হয়ে গেল মালে খড়ি । এবং চৌপাঠির দীঘির পাড়ে গমন !
ইতিমধ্যে অমরদা পন্চায়েতের মেম্বার নির্বিচিত হ’ল । তার চেলা হয়ে আমাদের খেপাও তাঁর পরিপার্সদ দলে সামিল হ’ল ।
গোবিন্দবাবু আমাদের বাড়ি পূজা করতে এসে দিদার কাছে খুব দু:ক্ষ করতেন, “ টোল চতুষ্পাঠির গুরু, ভট্টাচার্য্য বংশে, এ কি অনাচার !”
সেই দু:ক্ষ নিয়ে গোবিন্দবাবু অবসরের পর পরই এক বুক অভিমান নিয়ে চলে গেলেন । লিভারের রোগে তত দিনে অমরদাও সজ্যাসায়ি ! অমরদার ডাক্তারখানা বন্ধ হয়ে গেল ।
৭০এর দশক একান্নবর্তি পরিবারে সম্পর্ক্যে চিড ধরতে শুরু করল । প্রথমে বাড়ির মহিলাদের মধ্যে মনমালিন্য, কথা কাটাকাটি তারপর ভাইএ ভাইএ লাঠালাঠি । খেপার বড় জ্যেঠিমা এই অশান্তির মধ্যে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করল । প্রতিবেলা আধ মন (২০ কেজি) /২৫ সের চালের ভাত রান্নার হাঁড়ি ভেঙে টুগরো টুগরো হয়ে গেল । তবু চাষবাস ঠিকঠাকই চলছিল । কডে বামুনের ভাগে কিছু কম পড়ছিল না ।
কফিনের শেষ পেরেকটা এল, অপারেশন বর্গা । ফসলের ভাগ দেওয়াটা হয়ে দাঁড়াল ঐচ্ছিক । সংসারের লাক্সারীর ঐতিহ্য বজায় রাখতে কডে বামুন একটা একটা জমি বেচতে লাগল । তার মৃত্যুর পর ধসাও !
তত দিনে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে গেছি । বাইরে বাইরেই থাকি । কালেভদ্রে বাড়ি যাই । আমাদের প্রতিবেশি, কাশীনাথ মাইতির সঙ্গে বীরেনের সাইকেলের দোকানে বসে ধসা হুস হুস করে বিডি টানছে । কাশীনাথ আমার বাবার বয়েসি । সম্পর্কে বাবার ভাগ্না । তাই আমরা কাশীদা বলতাম । বিডি খাওয়ার সময় কাশীদা মামাকে সম্মান জানাতে মুখ ঘুরিয়ে বিডি ধরাত ।
কাশীদাদের একটা “শীতলা মঙ্গল “ গানের দল ছিল । ধসা নাকি সে দলের এখন গায়ক । এবং নাকি বেশ নামও করেছে । যেমন গানের গলা, তেমনি হাস্যরস মেশানো বক্তব্য । শিতলা মঙ্গল পালায় বেশ খানিকটা হাস্যকৌতুক ধরনের অভিনয়ও থাকে ।
এখন কোথাও গান গাইতে যাবে । কাশীদা হারমোনিয়াম বাজায় । কাশী মোড়ল আর অনিল মোড়ল খোল । সুকোদা (সুকুমার মন্ডল) মুনে মামা দোয়ার । তারা খন্জনি বাজায় । আরও কয়েক জন আছে দলে ।
কাশীদা বলল, “ ধসাকে এখন কড়া পাহারায় রাখছি । গানের আগে যদি চুল্লু খায়, পুরো আসর গুবলেট করে দেবে !”
বললাম, “গঙ্গা, মদ খাস নাকি?”
কাশীদা বলল, “ তাহলে শোনো, কাল পায়রাটাঙ্গী থেকে পূজো করে ফেরার পথে আমাদের শ্যামলার ঘরে হাজির । পূজোকরে চাল কলা যা পেয়েছিল, শ্যামলাকে দিয়ে পুরো দিন চুল্লু খেয়ে ওখানেই পড়েছিল । আজ আমি পাহারা না দিলে, এতক্ষণে চোখ লাল করে বসে থাকত !”
ধসা বলল, “বাইরে থাকিস । একটা সিগারেট খাওয়া তো !”
বীরেন পাশের চায়ের দোকানে সিগারেট আর চা বলে দিল । আমি চা-ই নিলাম । কাশীদার সামনে সিগারেট নিলাম না ।
বিরেন বলল, “তুই বাইরে বাইরে থাকিস । তবু সিগারেট খাস না । আর গঙ্গাকে দেখ পকেটে গাঁজা নিয়ে ঘুরছে !”
ধসা বলল, “পকেটেই পড়ে রয়েছে । কাশীদার জ্বালায় ধরাতে পারছি ?”
কাশীদা বলল, “গানের পর যা করার করবি । এখন না !”
৯০ এর দশকের শেষে দেশ ছাড়া হলাম । প্রথম টোকিও । তারপর ব্যাঙ্গালোর । দেশের সঙ্গে সম্পর্ক্য সকাল বিকাল বাবার সঙ্গে ফোনে কথা আর ছেলের ছুটি পড়লে বাড়ি যাওয়া ।
বাবা তত দিনে অবসর নিয়েছেন । সকাল বিকাল এক কেটলি করে চা আর এক বান্ডিল বিডি নিয়ে পেয়ারা গাছের নিচে মাচায় বসেন । প্রায় দশ পনের জন আসে । চা বিডি আর গল্পে দেশের আলোচনা হয় ।
তার মধ্যে কাশীদার গল্প ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা । সত্য মিথ্যার পাঁচনে তা হ’ত সত্যিই উপভোগ্য । আমি বাড়ি গেলে, দাদা কাশীদাকে উস্কে সে সব গল্প আদায় করত ।
দাদা বলত, “কাশীদার পেটে বিদ্যের পালিশ থাকলে, বাঙ্গলা সাহিত্য আরেকটা টেনিদা পেয়ে ধন্য হ’ত !”
কাশীদার মুখেই শুনলাম, ধসা বামুন মারা গেছে । শেষ দিকে নাকি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল । আর্থিক সঙ্গতি ছিল না । তাই ভালো চিকিত্সা করাবার সুযোগও পায়নি !
এখন সুকোদা শিতলা মঙ্গল গানের নতুন গায়ক ।
কাশীদা আগেই চলে গেছে । বাবাও আর নেই । সেই পেয়ারা গাছের নিচের মাচার আসরটাও ভেঙে গেছে । পড়ে রয়েছে কিছু বিবর্ণ স্মৃতি ।
নিশীথরঞ্জন অধিকারী
Comments
Post a Comment
Thank you, Stay connected & subscribe to this blog...