পাতুদায় গ্যাঁজ

পাতুদায় গ্যাঁজ 

“মাঝে মাঝে এই বৃদ্ধ মানুষটার খবর টবর নিবি তো, না কি ? এই ঠান্ডায় কবে টেঁসে যাব কে জানে !” ঝিঙেদা জলদ গম্ভীর গলায় বলল ।
আমি বললাম, “বালাই ষাট ! কি এমন ঠান্ডা পড়েছে ?”
 ⁃ “আমি তো কোন রকমে পাতুতে চা খাই আর রুমে গিয়ে লেপের তলায় ঢুকি !”
 ⁃ “চান টান না করে, ড্রাইদার মতো ৩৩ দিনের রেকর্ড করবে নাকি ?”
 ⁃ “আরে না না । ড্রাইদা নমস্য ! আমি হিটারে জল গরম করে প্রতিদিন চান করি । চান না করলে আমার গা চুলকায় !”

এক আর দুয়ের মাঝামাঝি সুবলদার ক্যান্টিন । সুবলদাকে আমরা পাতুদা বলতাম । ওখানে প্রধানত একের জনগনই যেত । দুয়ে রজ্ঞিতদার ক্যান্টিন ছিল । আমি অবশ্য সকাল বিকাল অশোকদার সঙ্গে কলেজ মোডে দাদুর দোকানেই যেতাম । দাদুর দোকানে খাটিয়ায় না বসলে আর যুগান্তরের শব্দযব্দ না আমাদের ঠিক চা হজম হ’ত না !
আজ কলেজে ভুতদার সঙ্গে দেখা ।
বললে, “এই যে ছানা, অনেক দিন তো এক নম্বরে আসিসটাসিস না । মাঝে মাঝে চাঁদ বদন খানি দেখাতে, আসতেও তো পারিস !”
পাশ থেকে জগাদা ফুট কাটল, “ Ragging Period এ ঠিকঠাক ক্যাল না খেলে, এরকমই হয় !”
ভুতদা বলল, “এ মালটাকে ক্যাল দিয়ে খুনের দায়ে জেলে যাই আর কি !”
আমার সাড়ে ৪২ কেজি ওজনকে যে যখন যেভাবে পারত হেটা করত । 
আমি আর বেশি কথা না বাডিয়ে বললাম, “আজ যাব !”
-“পাতুতে চলে আয় বিকালে । ওখানেই চা খাস !” ভুতদা বলল ।

তাই আজ পাতুদার ক্যান্টিনে আগমন এবং ঝিঙেদার কাছে হাজছি !
পটলদা আর ঝিঙেদা থাকত তিন তলা মিড উয়িংসে । এক নম্বরের পুরো তিন তলায় ঝিঙেদার বিশাল সাম্রাজ্য । ওদের Ragging Period এর একদম শুরুতেই ঝিঙেদার নামকরন প্রদীপ দাস থেকে “ঝিঙে” হয়ে গিয়েছিল । 
কিন্তু প্রদীপ দাস নামে আরো একজন, স্বনামে বাহাল তবিয়তে কি করে ঘুরে বেড়ায় ? তাই ঝিঙেদা তার নাম দিলো কাক ! ঝিঙেদা তাকে আবার মিস্টি করে মাঝে মাঝে ডাকে “বায়স” বলে - দাঁডি বায়স !
কাকদা আর ভুতদা দুজনেই ঝিঙেদার বড় নেওটা । আমাদের পরের ব্যাচের ফয়েলও । আমিই নামটা দিয়েছিলাম, “ঝিঙেদার কাউন্টার ফয়েল “ বলে । তার আসল নাম মনে নেই । আজ তাদের সঙ্গে জুটেছে পোনাদা ।
পোনাদার বাড়ি ছিল আসানসোলের দিকে । কম কথা বলে । দেখলে মনেহয় ভগবানের থেকেও শান্ত ছেলে । 
আমি এখন সেকেন্ড ইয়ারে আর ওরা থার্ড । আমি আইনত এখন পোনা । তবু এরা আমাকে হাজাতে ছাড়ে না । আর পোনাদা চা খেতে খেতে তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে !
আমাদের পরের ব্যাচের, মানে ফার্স্ট ইয়ারের কাক, সরু, কেল্টু আর ফয়েল এমন হাসছে যেন ভাল্লুকে শাঁকালু চেবাচ্ছে !

আমি ঝিঙেদাকে বললাম, “এতই যখন ঠান্ডা, বাড়ি চলে গেলেই পারো !”
 ⁃ “সে তো আমি যে কোনদিনই যেতে পারি !
কাকদা বলল, “ওর তো ঘরের ট্রেন !”
আমি বললাম, “ ঘরের কেন ?”
ঝিঙেদা বলল, “গনি খান তো আমাদের মালদার !”
 ⁃ “তাতে কি হ’ল ? তোমায় টিকিট কাটতে হ’বে না ?”
 ⁃ “না !”
 ⁃ “তা’লে কি টিটি পটবে ?
ঝিঙেদা বলল, “আমি পটাব টিটি ? বল টিটি আমাকে পটাবে । তবে শোন -“
সেদিন সিল্কের লুঙ্গীপরে রেলের বড় বড় অফিসারদের নিয়ে গনি সাহেব মালদা স্টেশনে পায়চারি করছেন । মালদায় থাকলে উনি প্রায়ই করেন । এক জায়গায় একটু গোলমাল দেখে উনি দাঁডিয়ে পড়লেন ,
“কি হ’ল বে, এতো গোলমাল কিসের ?”
টিটি কয়েকটা WT (Without Ticket) ধরেছে । ভাবল রেল মন্ত্রীর কাছে বাহবা নেবে ।
বলল, “স্যার এরা টিকিট কাটেনি !”
গনি খান বললেন, “কেন বে, টিকিট কাটিসনি কেন ? কেটে লিস !”
চেলাদের বলল, “তোরা একটু দেখে লে !”
চেলারা এমন দেখলো, যে সেই টিটিকে কোথায় বদলি করে দিল, কে জানে !
সূর্যেন্দুদা বলল, “ তোর কি কপাল মাইরি ! এমন কপাল হলে আমি রোজ নাডুদায় আপ্সু খেতাম ।”
ভুতদা বলল, “ঝিঙের নাহয় গনিদা আছে ! তবে আমাদের পোনা কিন্তু সবাইকে হার মানাবে !”
বললাম, “কি রকম ?”
 ⁃ “পোনাকেই জিজ্ঞাসা কর । এই পোনা বল না !”
একটু লাজুক হেসে পোনাদা শুরু করল - 

সকাল সকাল ভাতটাত খেয়ে হলদিবাডি থেকে দার্জিলিং মেলে চড়ে বসলাম । আমার আবার টিটিফিটি পটানোর ক্যালি নেই । নামব আমোদপুরে । ওখান থেকে বাসে শিউডি । শিউডিতে পিসিমার কাছে একদিন থেকে বাড়ি যাবো । শিউডি থেকেই বাস ছাড়ে ।
আমোদপুরে চেকিং টেকিং তেমন হয় না । খুব সকাল সকাল পৌঁছে যায় । স্টেশনে ঢোকার আগেই ট্রেন থেমে যায় । আমি টুক করে নেমে পডি । তারপর দু’পা হেঁটে স্টেশনের বাইরেই শিউডির বাস ।
সেদিন বরাত সত্যিই খারাপ । এই শালা দাঁড কাকের মুখ দেখে উঠেছিলাম !
ট্রেন একে বিফোর টাইম, তার উপর আমোদপুরের বাইরে না দাঁডিয়ে, একদম প্লাটফর্মে এসে থামল । মনে মনে ভাবলাম, বাস তো সকাল আটটার আগে ছাড়বে না । এতক্ষণ কি করব !
এমন সময় টিটি এসে খপ করে ধরল । বলে, “টিকিট !”
আমি বললাম, “নেই ।”
বলল, “ফাইন দাও ।”
আমি দেখলাম অনেককেই ধরেছে । কিন্তু কেউ ফাইন দিচ্ছে না । আর এখন ফাইন দিয়ে বাইরে কোথায় বসব ?
তাই সবার সঙ্গে আমিও চলে গেলাম । আমাদের একটা বড় ওয়েটিং রুমে সান্টিং করে দিলে । সেখানে দেখি এক সাধুবাবা ছিলম বানাচ্ছে ।
বললাম, “বাবা, প্রসাদ !”
বাবা বললে, “বৈঠ, বেটা !”
আহা ! বাবা বড় উপাদেয় বানিয়েছে । ক’টানেই বেশ ধুন ধরে গেল !
বাবা বললে, “বেটা, তুঝে দম হ্যায় ! ইতনা বহৎ কম আদমি সকে গা ।”
বললাম, ‘বাবা আমরা হোস্টেলে মরস খাই । তবে তোমার বস্তুটিও বেশ উপাদেয় !’
দশটায় আমাদের কোর্টে তুলল । আমাদের আগের ব্যাচের দয়াময়দাদের কেসটা মনে আছে । তাই কাউকে ঘুনাক্ষরেও বলিনি আমি জলপাইগুডি ইন্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র । যদি আমাকেও ইলেক্ট্রিক্যালে ট্রান্সফার করে দেয় !
খালি ভয়, যদি ব্যাগ চেক করে, তাহলেই গেছি । দু’চারটে ইন্জিনিয়ারিং এর বই আছে । পডি না পডি নিয়ে তো যেতে হবে । না হ’লে বাড়িতে প্রেস্টিজ থাকবে ?
বিচারক বলল, “টিকিট কাটোনি কেন ?”
সাধুবাবার শিখিয়ে দেওয়া বানী, বললাম, “হুঁজুর পয়সা নেই !”
তাড়াতাড়ি বিচার হয়ে গেল, ট্রেজারিতে ফাইন সহ টিকিটের দাম জমা করে, কোর্টে রসিদ জমা করতে হ’বে । অনাদায়ে দু ঘন্টা রোদে বসে থাকতে হ’বে !
সাধুবাবা বোঝালো, “ট্রেজারিতে দৌডাদৌডি করতে গেলে হাজার হ্যাপা । দু ঘন্টার বেশি লেগে যাবে । তার চেয়ে এই শীতকালে দু ঘন্টা মিঠে রোদে বসে গাঁজা টান! বেশি আরাম পাবি ।”
আমরা রোদে বসে পড়লাম । সাধুবাবা ছিলম বানালো । আমিও প্রসাদ পেলাম । বারোটায় ছাড়া পেলাম । পেটে ছুঁচোয় ডন বৈঠক দিতে শুরু করেছে ।
হোটেলে পেট পুরে ভাত, ডাল, তরকারি আর মাছ খেলাম । শেষ পাতে আবার টক ! গাঁজার নেশায় হেব্বী টানলাম ।
খেয়েদেয়ে উঠে দেখি শিউডির বাস ছাড়ছে । টুক করে উঠে সামনে একটা সিট পেয়ে বসে পড়লাম । পিসিমার বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছাতে বিকেল !


নিশীথরঞ্জন অধিকারী

Comments

Science

Popular Posts

ভটচাজ সাহেব

এবার তোরা ত্রিশূল ধর

বাংলার তুল্য শ্রুতিমধুর আর কোন ভাষা!

কেমন আছো আকাশ

।। বৃত্ত টা কিন্তুু ছোটো হয়ে আসছে, আপনি সুরক্ষিত তো? ।।

ধসা বামুন

ছিদ্রান্বেষণ

1.দুইটি পরমাণুর ভর সংখ্যা একই হলেও, নিউট্রন সংখ্যা কম হয় কেন? নিউট্রন কেন আধান নিরপেক্ষ?

অহল্যা

চিঠি