আমি এখন ঘুমাতে চাই

#গল্পঅল্প

আমি এখন ঘুমাতে চাই  

রাত দুটোর সময় আমি ঘরের দরজা খুলে ছাদে এলাম। আজ রাতে ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। আমার মাঝে মাঝে এরকম হয়, রাতে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না।তার ওপর আজ আবার খুব খিদে পেয়েছে। ভেবেছিলাম আজ পুরো দিন কোথাও বের হব না, ঘরেই থাকবো। সারাদিন শুয়েই শুয়ে ভেবছি, মাঝে মাঝে ঘুমিয়েও গেছি। সেই ভাবনার কোন গতিপ্রকৃতি নেই। আমার এমনি এমনি ভাবতেই ভালো লাগে। ভাবতে ভাবতে সময় কোথা দিয়ে চলে যায়, টের পাই না। সারাদিন ভাবার পর রাতের দিকে একটু খিদে পেতে শুরু করেছে।ক্ষিদে ভুলে যাওয়ার একটা ভালো উপায় হল ঘুমিয়ে পড়া। তাই অনেকক্ষন ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু ঘুম আসছে না, খিদেটা খুব জ্বালাচ্ছে। একটা ফ্ল্যাট বাড়ীর চারতলার এক চিলেকোঠার ঘরে আমি থাকি। এই বিল্ডিং তৈরী করার সময় এই ঘরটা কেন বানানো হয়েছিল জানি না। একটা ছোট ঘর শুধু। বাথরুম যেতে হলে আমাকে নীচের এজমালি বাথরুমে যেতে হয়। হয়তো বিল্ডিং এর মিটিং টিটিং এই ঘরে হবে ভাবা হয়েছিল, এখন এই ঘরটা আমি পেয়েছি থাকার জন্য, ভাড়া দিতে হয় না এটাই সুবিধে। এই ঘরটা কি করে আমার আস্তানা হল, সে অন্য গল্প। তখন আমি কলেজ পাশ করে গেছি, কাজ কাম কিছু করি না, কলকাতায় থাকার জায়গাও নেই, বাঘাযতীন ষ্টেশনে রাতে ঘুমাই।তাতে আমার যে খুব অসুবিধে তা না। শুধু ভোর থেকে রাত দশটা অবদি এমন হৈ হট্টগোল থাকে যে নিজের ভাবনা চিন্তার খুব অসুবিধে হয়। সেই সময়ে আমি জল সংরক্ষণ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছিলাম। স্নানের সাথে কত জলের অপচয় হয় এ হিসেব নিকেশ করতে গিয়ে নিজেও দিনের পর দিন স্নান করতাম না। একজন মানুষ নূন্যতম কত জলে চালিয়ে নিতে পারে সেটা নিয়েও কাজ করছিলাম। দিনের পর দিন স্নান না করে আমার গায়ে তখন দুর্গন্ধ। দাড়ি কামানো, চুল আঁচড়ানোর পাট তো কলেজ ছাড়ার পরই ছেড়েছি।সেই সময় আমার বন্ধু প্রদীপ একবার বাঘাযতীন স্টেশনে আমার সাথে দেখা করতে এসে আবার অবস্থা দেখে খুব ঝামেলা করল।প্রদীপ নিজে এই আস্তানাটা খুঁজে দিল। জল সংরক্ষণের কাজটা পুরো হল না। দু একদিন স্নান না করে থাকলেও তার বেশি এই বাড়িতে থাকা সম্ভব না। এই বাড়ীটা বানিয়েছিল প্রদীপের দাদা। তৈরী হয়ে গেছে, কিন্তু কোন সমস্যায় ফ্ল্যাট বিক্রি হয়নি তখনও, ফাঁকা বাড়ি থাকবে, তার চেয়ে একজন থাকা ভালো, সেই হিসেবে আমার এই ঘরে আসা।পরে সব ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে লোক এসে গেছে, কিন্তু আমি রয়েই গেছি ওপরে। বড় বাইরে, ছোট বাইরের জন্য নীচে যাই, খিদে পেলে রাস্তার ধারে একটা হোটেল আছে, সেই হোটেলে অনেক দিন বিল মেটানো হয় নি। কিন্তু সেই লজ্জায় আমি আজ খেতে যেতে পারি নি তা ঠিক না। কারন হোটেল মালিক বলাই দা আমার কাছে কোন দিন টাকা চায় না, অনেকদিন টাকা বাকী এটা বুঝতে পারি যখন ভাতের সাথে দেওয়া বাটির সংখ্যা কমতে থাকে। কাল রাতে ভাতের সাথে শুধু একবাটি ডাল পেয়েছিলাম। আমি একটা লঙ্কা চেয়েছিলাম, বললাম, ‘একটা লঙ্কা দেন,বলাই দা, ডালের সাথে লঙ্কা চিবিয়ে খেলে যেন অমৃত,’ বলাই দা মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘লঙ্কা নাই’। আমি অবশ্য জানি লঙ্কা আছে। নেপাল, বলাইদার কর্মচারী মুখ চুন করে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। সে অবশ্য আমাকে খুব ভালোবাসে, কোন কারণ ছাড়াই, মালিকের ওপর কোন কথা বলতে পারে নি, কিন্তু পরের হাতা ডাল যখন দিল দেখি তার মধ্যে দুটো ডালের লঙ্কা, আমার আনন্দে চোখে জল এসে গেল, এখন এই হয়েছে, অল্পতে চোখে জল এসে যায়। যাইহোক, বলাইদার লঙ্কা তে না করা তে বুঝলাম যে অনেকদিন হোটেলের বিল বাকি, সেটা অবশ্য ঠিক কথা, অনেকদিন কিছু দেওয়া হয় নি, টাকা পয়সা পাই নি। এবার কিছু টাকা পেলে প্রথমেই বলাই দাকে দিতে হবে।ধার বেশি বাকী রাখা ঠিক না। খিদে পেটে থাকা আমার অভ্যাস আছে, কিন্তু খিদে পাচ্ছে অথচ খেতে পাচ্ছিনা তখন খুব বিরক্ত লাগে। আজ দুপুরেও খাওয়া হয় নি, বের হতে ইচ্ছে করছিল না, রাতেও বের হতে ইচ্ছে করছিল না, আজ বলাই দা কি শুধু ভাত দিত, ডাল দিত না? জানি না, আমি ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিলাম, ঝিমলির ফোন এসেছে কয়েকবার, ধরতে ইচ্ছে হয় নি। যাতে আওয়াজে ঘুম না ভাঙ্গে তাই ফোন ভাইব্রেট মোডে রেখে দিয়েছিলাম, তাতেও ঘুম আসে নি। এখন অবশ্য আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না, ঘুম ও আসছে না, খিদে পেটে ঘুম ভালো আসে না। এখন রাত দুটো বেজে গেছে, এমন সময় খিদে নাগালের বাইরে বেরিয়ে গেল যে বলাইদার হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে, কিছু করার নেই। আমি সামনের ছাদে এসে দাঁড়ালাম।আকাশ জুড়ে গোল চাঁদ। পূর্নিমা আজ নয়তো আগামী কাল, গতকাল ও যেতে পারে। পুর্ণিমার রাতেই আমি দেখেছি আমার ঘুম আসে না বা ঘুম ভেঙ্গে যায়।  

আমি ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ গোল চাঁদ দেখলাম। কিন্তু এত খিদে পাচ্ছে, চাঁদ দেখতেও ইচ্ছে করছে না। কি করি। এই বাড়ীর কোন ঘরেই আলো জ্বলছে না, সবাই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কারো ঘরে গিয়ে বেল বাজিয়ে বলব, ‘আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটু খাবার পাওয়া যাবে?’ নিশ্চয় খুব চমকে উঠবে সেই মানুষটা। এই বাড়ীর লোকজন আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না। এই সুন্দর বাড়ীর সাথে একদমই খাপ খাই না। এখানে সবাই খুব গোছানো, পরিষ্কার জামা কাপড় পড়া, সেখানে আমি চূড়ান্ত অগোছালো, রোজ স্নান করা, দাড়ি কামানো আমার ভালো লাগে না। তারওপর প্রমোটারের লোক বলে আমাকে খোঁচর ও মনে করে, ভাবে সব খবর আমি প্রদীপের দাদাকে পাচার করি। ধুস ভালো লাগছে না। ঝিমলি সারাদিন অনেকবার ফোন করেছে, ওকে ফোন করা যেতে পারে, কিন্তু রাতে ও মোবাইল অফ করে ঘুমায়। ওদের ল্যান্ডলাইনে ফোন করা যায়। কিন্তু সেই ফোন আছে ঝিমলির বাবার ঘরে। ঝিমলির বাবা আমাকে একদম পছন্দ করে না। সেটা স্বাভাবিক। কোন বাবা চায় এই রকম বাউন্ডুলে এক ছেলের চক্করে মেয়ে পরুক। আমি যদি ফোন করি, আর ঝিমলির বাবা ধরেন, কথোপকথন এরকম হতে পারে,
- (ঘুম চোখে, ঝিমলির বাবা) হ্যালো, কে? 
ঝিমলি বলে দিয়েছে ওর বাবার প্রেশার আছে, তাই কখনই উত্তেজিত করা যাবে না, আমি তাই গলা নরম করে বিনীত স্বরে বলি,
-‘কাকু ঘুমাচ্ছিলেন?’
-‘রাত দুপুরে কে মস্করা করছেন?’
-একটু কাইন্ডলি ঝিমলি কে ডেকে দেবেন? 
- (রাগত স্বরে) কে? এত রাতে ভদ্র বাড়ীর মেয়েকে ফোন করছ?
-(শান্ত স্বরে) আমাকে ভুলে গেছেন কাকু? ঝিমলির সাথে কলেজে পড়তাম। গত পুজোয় ঝিমলির সাথে দেখা করতে আপনার বাড়ী গেছিলাম। আপনাকে প্রণাম করতে গেছিলাম, আপনি আমার দাড়ি না কামানো, চুল না আঁচড়ানো চেহারা দেখে, তারওপর জামার হাতাও ছেঁড়া ছিল, আপনি চমকে সরে যান, প্রণাম করতে দেন নি’
-‘ও তুমিই সেই লোফার ছোঁড়া, এত রাতে কি মনে করে?’
-‘অনেকদিন ঝিমলির খবর পাই না তো, একটু কথা বলতাম, আমার ঘুম আসছে না, ওর সাথে একটু গল্প করতাম’
-‘ কিইইইইইই’ ঝিমলির বাবা কথা খুঁজে পাচ্ছেন না
-‘একটু ঝিমলিকে যদি কাইন্ডলি ডেকে দেন’
-‘এতোওওওও বড় সাহস, আমার মেয়ে কে মাঝ রাতে ডিস্টার্ব করা!’
-‘স্যার, একটু কথা বলতাম শুধু, ডিস্টার্ব না’
-‘তুমিইইইইইইই’। ঝিমলির বাবার রাগ চড়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে। উনি কথা খুঁজে না পেয়ে তোতলাতে শুরু করেছেন। আমি আস্তে করে ফোনটা কেটে দিলাম। 
এসব অবশ্য কিছুই ঘটল না। আমি ঝিমলির বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করলাম না। শুধু ঝিমলির মোবাইলে একটা মেসেজ করে দিলাম। ‘খুব খিদে পেয়েছে’। সকালে উঠে ও দেখবে।

চাঁদ দেখতে দেখতে মনে হল, রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসা যায়। হেঁটে জগত সিনেমার সামনে চলে যেতে পারি, ওখানে ফুটপাথে থাকে মনসুর। ওর কাছে গেলে কিছু না কিছু খাবার পাওয়া যাবেই। মনসুর থাকে জগতের সামনের ফুটপাথে, কিন্তু ও ভিক্ষা করে শিয়ালদা স্টেশনেরর সামনে। ভিক্ষা করার সময়ে এক পা খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে। ময়লা জামা কাপড় পরে করুন মুখ করে সামনে এসে দাঁড়ায়। মনসুরের সাথে আমার আলাপ শিয়ালদা স্টেশনের সামনেই। সেদিন ঝিমলি আমাকে একটা জামা গিফট করেছিল। কিন্তু শেষদিকে কোন কারনে খুব রেগে যায়। অন্যদিন বাড়ী ফেরার আগে বাস ভাড়া হিসেবে আমাকে দশ- বিশ টাকা গুঁজে দিয়ে যায়। সেদিন যেহেতু খুব রেগে চলে যায়, তাই আমার হাতে কোন টাকা না দিয়েই চলে যায়। তাই মনসুর এসে যখন করুণ মুখে আমার সামনে হাত পেতে দাঁড়ায়, আমার কাছে দেওয়ার মতো কোন টাকা-পয়সাই নেই, অথচ হাতে একটা নতুন জামার প্যাকেট। আমি কি ভেবে জামার প্যাকেটটা মনসুর কে দিয়ে দিই। প্রথমে প্যাকেটটা পেয়ে মনসুর অবাক হয়ে যায়। প্যাকেটটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন টাটকা জামার প্যাকেট। মনসুর প্যাকেটটা নিয়ে একটু হতবুদ্ধি ভাবে দাঁড়ায়, তারপর দৌড় দেয় জগতের দিকে, তখন আর পা খোঁড়া নেই, ঠিক হয়ে গেছে। ওর দৌড় থেকে আমি একটু অবাক হয়ে যাই, তারপর ভুলেও যাই। মনসুরই আমাকে বেশ কিছুদিন পরে শিয়ালদা স্টেশনে খুঁজে বার করে। সেদিন আর আমার কাছে পা টেনে এসে করুণ মুখে ভিক্ষে চায় নি। সোজা এসে জিজ্ঞেস করে,
-‘আপনি ওইদিন নতুন জামাটা আমাকে দিয়ে দিলেন কেন?’
-‘ও, আপনাকে দিয়েছি? সেদিন কোন টাকা পয়সা ছিল না, তাই কি দেব, ওটাই দিয়ে দিলাম, আমার আরো কয়েকটা জামা আছে’ 
-‘নতুন জামা খুব কেউ দেয় না তো হঠাৎ করে, তাই একটু অবাক হয়েছিলাম’
-‘জামাটা পড়েছেন? মাপ মতো হয়েছে আপনার?’
-‘আমি পড়ি নি তো, ১০০ টাকায় বেঁচে দিয়েছি’
-‘সে কি? কি করেছেন? ডাহা লস করেছেন তো! অ্যালেন সোলির ব্রান্ডেড জামা বেচে দিলেন? কম করে হাজার টাকা দাম হবে, পুরো নতুন জামা’
-‘কি করবো বলেন? আমাদের লাইনে নতুন জামার দাম নাই, আমার ছেলেও ছোট, ওই জামা ওর হত না’

সেদিন মনসুরের সাথে অনেক গল্প হল। ওর নাম জানলাম।খুব গোছানো লোক।আমার চেয়ে বেশ ধনী। শিয়ালদার সামনে ভিক্ষে করেই সে তালদির কাছে জমি কিনে ছোট একটা বাড়ীও করেছে। মেয়ে সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে, ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। মাসে একদিন দুদিনের জন্য বাড়ী যায়। একটাই সমস্যা বাড়ী গিয়ে বেশি দিন থাকতে পারে না। এখানে জায়গার খুব কম্পটিশন। ভিক্ষের জায়গা যদি বেহাত হয়ে যায়, খুব মুশকিলে পরে যাবে। আমি মনসুরের সমস্যা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ি। সেদিন মনসুর আমাকে ওর ঝোলা থেকে একটা সিগারেট বার করে খেতে দেয়। আমি আর মনসুর সিগারেট ভাগ করে খেতে খেতে শিয়ালদা স্টেশনের সিঁড়ি তে বসে সুখ দুঃখের গল্প করি।সিগারেট বার করতে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে দেখেছি মনসুরের ঝোলায় শুধু সিগারেট না অনেক রকম খাবার ই থাকে। মনসুর আমাকে তার তালদির বাড়ি যেতে নিমন্ত্রণ করে, আমি বলি তালদি কবে যাব জানি না, কিন্তু জগতের সামনে ওর ডেরায় একদিন নিশ্চয়ই যাবো।

এরপর ও মনসুরের সাথে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। কোনদিন আমার কাছে কিছু চায় নি। বরঞ্চ প্রতিবার ওর ঝোলা থেকে কেক, বিস্কুট বার করে খাইয়েছে। একবার তো ক্যডবেরী ও খাইয়েছিল। আমি মনসুরকে দেখে অবাক হয়ে যাই। একবার ওর রাতের আস্তানা, জগতের সামনের ফুটপাথে রাতে থেকেওছিলাম। সারারাত দুজনের গল্প করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেরাতে আমার এত ঘুম পেয়ে গেল। ওর পাশে সেই রাতে ফুটপাথে শুয়ে খুব ভালো ঘুমিয়েছিলাম। 
 
আমি রাস্তায় নেমে আসি।রাতে রাস্তায় বের হলে কোন না কোন কুকুর আমার সঙ্গী হবেই। কুকুর আমি মোটেই পছন্দ করি না, কিন্তু তাও একটা কুকুর আমার সাথে সাথে যাবেই। রাস্তার সাথে সাথে কুকুর পালটে যায়, কিন্তু একটা না একটা আমার সাথে সাথে যাবেই। বিরক্ত করে না, শুধু পিছন পিছন যায়, আমার খুব একটা খারাপ লাগে না। আজ তো মাথার ওপর পূর্নিমার চাঁদ ও আমার সাথে সাথে চলেছে। কলকাতার রাস্তায় এই নিশুতি রাতেও মানুষজন কম নেই, কিন্তু কেউ আমার দিকে লক্ষ্য করে না, আমিও করি না। আমি নিজের মনে আকাশের চাঁদকে নিয়ে জগতের দিকে হেঁটে যাই, যুধিষ্ঠীরের মতন লাগে নিজেকে, যখন পিছন দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা না একটা কুকুর আমার সাথে সাথে চলছে। 

জগতের সামনে গিয়ে চমকে গেলাম। ফুটপাথে নিজের জায়গায় মনসুর নেই। ওর শোয়ার জায়গাটা পুরো খালি। একটু দূরে থাকে হরি। সে অবশ্য বউ বাচ্চা নিয়েই থাকে, তার কোন দেশের বাড়ী নেই। হরিকে জাগালাম ঘুম থেকে। সারাদিন খাটুনির পর মরার মত ঘুমাচ্ছিল। অনেক ডাকার পর, চোখ খুলে আমাকে দেখে উঠে বসল। একটা বিড়ি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘নেন, বিড়ি খান, এত রাতে, কি ব্যাপার?’ এটা হরির স্পেশাল বিড়ী।মশলায় গাঁজা পাঞ্চ করা থাকে। সবাইকে দেয় না। তবে আমার সাথে যখনই দেখা হয়, এই বিড়িই দেয়। 
আমি বিড়ি টা ধরালাম, বেশ কড়া, খিদে পেটে কড়া বিড়িও তেঁতো লাগে। ‘মনসুর কোথায়? ওর জায়গা খালি দেখছি’
-‘সে তো দেশে গেছে, কাল আসার কথা’
যা! মনসুর দেশে গেছে, এখানেও কিছু জুটবে না। আমি হরির সাথে গল্প করতে করতে বিড়িটা শেষ করলাম।
‘নেন, আপনি ঘুমান, আমি এগোই’
-‘রাত তো প্রায় শেষ, সাবধানে যাবেন’ 

আমি শিয়ালদা স্টেশনে ঢোকার আগে সঙ্গী সারমেয় কে বিদায় জানাই। সে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে লেজ নেড়ে আমাকে বিদায় জানায়। আকশের দিকে তাকাই। না কোন চাঁদ দেখা গেল না। চাঁদেরও ডুবে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। মাথাটা একটু ঝিম ঝিম করছে। শিয়ালদা স্টেশনে অল্প অল্প ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। দিনের প্রথম ট্রেন ছাড়ার টাইম হয়েছে মনে হয়। 

আমি কলের সামনে গিয়ে ভর পেট জল খাই। পেট ভরে উঠল।এতটা হেঁটে এসেছি, তার ওপর কড়া বিড়ি। এবার ঘুম পেতে শুরু করেছে। আমি ফার্স্ট যে ট্রেন ছাড়বে, তার একটা ফাঁকা কামরা খুঁজে বার করি। কামরার শেষ সীটে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি। একটু পরই পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। আমি কামরা ভাসিয়ে বমি করি। শুয়ে শুয়েই। আমার একদম উঠতে ইচ্ছে করছে না। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।

ঘুমাতে ঘুমাতেই বুঝতে পারি, কিছু লোক কথা বলছে, কিন্তু তারা কেউ এদিকে আসছে না। ট্রেন নড়ে উঠে চলতে শুরু করল। আমার প্যান্টের পকেটে ভাইব্রেট মোডে রাখা মোবাইল কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘুম থেকে উঠে মোবাইল অন করে মেসেজ দেখে হয়তো ঝিমলি ফোন করেছে। আমি ফোনে হাত দিই না। 

আমি এখন ঘুমাতে চাই।

শ্রাবণ ঘোষ
০২.০৮.’২০

Comments

Science

Popular Posts

ভটচাজ সাহেব

এবার তোরা ত্রিশূল ধর

বাংলার তুল্য শ্রুতিমধুর আর কোন ভাষা!

কেমন আছো আকাশ

।। বৃত্ত টা কিন্তুু ছোটো হয়ে আসছে, আপনি সুরক্ষিত তো? ।।

ধসা বামুন

ছিদ্রান্বেষণ

1.দুইটি পরমাণুর ভর সংখ্যা একই হলেও, নিউট্রন সংখ্যা কম হয় কেন? নিউট্রন কেন আধান নিরপেক্ষ?

অহল্যা

চিঠি