আমি বাবলু

#গল্পঅল্প

আমি বাবলু 

‘বাবলু, এই বাবলু, এই যে এই দিকে, অ্যাই বাবলু, এই দিকে’  
ভর দুপুরে বিবেকানন্দ পার্কের সামনের বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি, একটু ঢাকুরিয়ার দিকে যাব, কাজ আছে, এমন সময় এই ডাক। গরম টা বেশ জাঁকিয়ে পরেছে, রাস্তায় লোকজন বেশি নেই, বাস স্টপে আমি একাই। তরুণী কন্ঠের আওয়াজে চমকে তাকালাম। বাবলু বলে কে কাকে ডাকছে আবার! তাও আবার এই রকম চিৎকার করে, আশে পাশে ত কেউ নেই। আমি তাকিয়ে দেখলাম, উল্টোদিকের রাস্তায় এক তরুণী নারী বাসের জানলা দিয়ে হাত বার করে আমার দিকেই কাউকে ডাকছে, উত্তেজনায় তার মুখের অনেকটা বাসের জানলা দিয়ে বিপজ্জনক ভাবে বেড়িয়ে এসেছে। মুখটা ভাল করে দেখা গেল না, তবে ঘামে ভিজে, কপালের টিপটা এখন আর মাঝখানে নেই, ঘাম মুছতে গিয়ে একটু সরে গেছে মনে হয়। হাতের সাথে সাথে সবুজ ওড়নাটাও জানলা দিয়ে ঝুলছে। কিন্তু ডাকছে কাকে? বাসস্টপে তো কেউ নেই। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে সামনে পিছনে দেখলাম, না কেউ নেই। তাহলে কি আমাকে ডাকছে? কিন্তু আমার নাম ত বাবলু না, আর কস্মিনকালেও মেয়েটিকে আমি দেখেছি বলে মনে হয় না। আমি আবার বাসটার দিকে তাকালাম। বাসটা ইতিমধ্যে খানিকটা এগিয়ে গেছে। মেয়েটি একই ভাবে জানলা দিয়ে মুখ আর হাত বের করে আছে। আমি মুখ ফেরাতেই, ব্যাকুলভাবে আবার ডেকে উঠল, ‘বাবলু, বাবলু, এই দিকে’। আমি অবাক হয়ে তাকিয়েই আছি। বাসটা যখন চোখের সীমানা পেড়িয়ে চলে যাবে, সেই মুহুর্তে মেয়েটি হাতের আঙ্গুল দিয়ে ফোনের ভঙ্গী করে আমার দিকে ইঙ্গিত করলো, মানে ফোন করার কথা বোঝাতে চাইল, কিন্তু আমি ফোন করব কি করে? আমি তো ফোন নং জানিই না, মেয়েটিকেও চিনতে পারছি না, আর আমিও বাবলু না। আমার চোখের সামনে দিয়ে বাসটা সাদার্ন এভিনিউ দিয়ে রাসবিহারীর দিকে চলে গেল। আমার বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে কষ্ট রয়ে গেল। মেয়েটি যেভাবে ব্যকুল হয়ে, বিপজ্জনকভাবে বাসের জানলা দিয়ে মুখ-হাত বাড়িয়ে ‘বাবলু বাবলু’ বলে ডাকছিল, আমার মনে হল ওর বাবলু কে খুব দরকার। কিন্তু বাবলু তো আমার নাম না, আমি সেই বাবলুও নই।   

বাবলু আমার নাম না, সেটা অবশ্য পুরো ঠিক না। আমার দিদা আমাকে খুব ছোটবেলায় বাবলু বলে ডাকতেন। ঠাকুরমার অবশ্য দিদার দেওয়া নাম পছন্দ ছিল না। ঠাকুমা আমাকে ঠাকুর দেবতার নাম দিতে চেয়েছিলেন, তাই কৃষ্ণ বলে ডাকতেন। কৃষ্ণ নামটাই আমার ডাক নাম হয়ে গেল। মামারবাড়ি যখন যেতাম দিদা আমাকে বাবলু বলেই ডাকতেন, কখনই কৃষ্ণ বলতেন না। অবশ্য দিদা বেশিদিন বাঁচেন নি। আমার খুব ছোট বয়সেই দিদা মারা যান।দিদা মারা যাওয়ার সাথে সাথেই আমার বাবলু নামের অবলুপ্তি ঘটল।এখন আর আমাকে কেউ বাবলু নামে ডাকে না।এখন কেউ জানেই না, যে একসময় আমকে কেউ বাবলু বলে ডাকতো, এই মেয়েটির তো জানার কথাই না। আর সেটা খুব ছোটবেলার ঘটনা, সেই সময়ের চেহারার সাথে আমার এখনকার চেহারার কোন মিল নেই। দিদার কয়েকটা চিঠি এখনও মায়ের কাছে আছে, মাকে লেখা। সেখানে আমার উল্লেখ করা হয়েছে, বাবলু নামে, যেমন ‘বাবলু কেমন আছে? বা বাবলুকে আমার স্নেহাশীর্বাদ দিও’ এইরকম কিছু সাধারন কথা।  

বাবলু বলে মেয়েটির ডাক বেশ কয়েকদিন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াল। বাবলু নামে মানুষটিকে আমি একটু ঈর্ষা করতেও লাগলাম। একজন তরুণী তাকে ব্যাকুলভাবে ডাকে, ফোন করতে বলে। আমাকে কোন তরুণী নারী এইভাবে ডাকে না, কোন তরুণী ফোন করতে বলে না, ফোন করা যায় সেরকম কোন তরুণীর ফোন নং ও আমি জানি না।বাবলু সেইদিক থেকে আমার থেকে অনেক ভাগ্যবান। কদিন পর অবশ্য ঘটনাটা ভুলেও গেলাম।

এই সময়ে আর একটা ঘটনা ঘটল। দিন কয়েক পর আমি ডিউটি করতে যাচ্ছি। সে দিন বি শিফট ডিউটি। বাইপাশের ধারে একটা হাসপাতাল তৈরী হচ্ছে। আমি সে দিন রিলিজ করবো নবা কে। নবার ছিল এ শিফট। নবা খুব ভয়ংকর ছেলে, সে নিজে কোনদিন ডিউটি তে দেরী করে আসে না, আগেই এসে রিলিজ করে দেয়। কিন্তু কেউ যদি ওকে দেরী করে রিলিজ করে, খুব রেগে যায়, তার চোদ্দ গুষ্ঠী উদ্ধার করে, বাছা বাছা বিশেষণ প্রয়োগ করে। তাই আমি একটু ভয়ে ভয়ে আছি। রিলিজের টাইম প্রায় হয়ে গেছে, আমি এখনও সাইটে ঢুকতে পারিনি। ট্রেন টা একটু লেট করলো, তারপর বাস পুরো রাস্তাটা ঢিকির ঢিকির করে এলো। বাস থেকে নেমে আক্ষরিক অর্থে দৌড়াচ্ছি। সাইটের গেট প্রায় এসে গেছে, এবার ঢুকে যাব সাইটে, এমন সময় গা ঘেঁসে একটা বেশ বড় গাড়ী এসে হর্ন বাজিয়ে দাঁড়াল। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে গালাগাল দিতে যাব, গাড়ির চেহারা দেখে থমকে গেলাম। সাথে সাথে শোফারের ড্রেস পরে ড্রাইভার বেড়িয়ে এসে আমাকে নরম স্বরে বলল, 
-‘বাবলুবাবু, আপনাকে বড় মেমসায়েব আর ছোট মেমসায়েব গাড়িতে ডাকছেন’।  
-‘কিন্তু আমি তো বাবলু না, আমার নাম বাবলু না’
-‘সে আমি জানি না সায়েব, আমাকে মেমসায়েবরা বললেন, ওই যে বাবলু যাচ্ছে, গাড়িটা ওর কাছে দাঁড় করিয়ে ওকে ডেকে নিয়ে এসো, চলুন স্যার’    
প্রথমে ভাবলাম যাবো না, কাকে না কাকে ডাকছে ভুল করে, দেরী করে ঢুকলে নবার পালটে যাওয়া মুখটা কি হবে সেটাও মনে পড়ল, কিন্তু আবার মনে এক কৌতূহলও আছে, এখানেও বাবলু, কে এই বাবলু! নবাকে পরে সামলে নেওয়া যাবে, আগে এটা তো বুঝে নি। আমি ড্রাইভারের সাথে গাড়ির দিকে ঘুরলাম। গাড়ির এসি চলছে, তাও কাঁচ নামিয়ে এক বয়ষ্কা মহিলা আমাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চেহারাতে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। গাড়ির ভিতরে এক চোদ্দ পনের বছরের বাচ্চা মেয়েও আছে। সে ও জানলা দিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। আমি যত গাড়ির দিকে এগোতে থাকলাম তত বুঝতে পারলাম ওই বয়ষ্কা মহিলার চোখে মুখে এক হতাশার ছাপ ফুটে উঠছে। আমি গাড়ির জানলার পাশে এসে দাঁড়াতেই, উনি একটু অনুশোচনার স্বরে বললেন,  
-‘সরি, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একদম আমাদের এক চেনা মানুষের মতো লাগছিল, কিন্তু কাছে আসতেই বুঝলাম সে আপনি না। প্লীজ কিছু মনে করবেন না, আমি খুব দুঃখিত’।  
-‘না না ঠিক আছে, ভুল তো হতেই পারে, এ আর এমন কি’। আমি কি বলব আর একজন বয়ষ্কা মহিলা কে, তার ওপর তো আর রাগও দেখানো যায় না, পেছন ফিরে সাইটের গেটের দিকে এগোতে এগোতে শুনলাম, গাড়ির ভিতর থেকে সেই কিশোরী মেয়েটি বলছে, ‘তোমাকে বারবার বললাম, এ বাবলু দা না, তুমি শুনলেই না, কি বিশ্রী ঘটনা ঘটল’
‘কি করব বল, একদম বাবলুর মতো লাগছিল কিনা তুই বল, তার ওপর আকাশী জামা, বাবলুর এরকম একটা জামা আছে না!’
আমি সাইটের গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলাম, আবার বাবলু। কে এই বাবলু, যাকে অনেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে আর আমার সাথে ভুল করছে?
 
বাবলু নামটা আমার মাথায় রয়ে গেল। কে এই বাবলু? আমিই কি সেই? আমিই যদি সেই বাবলু হই কেমন হয়? আমি নিজেকে নিজে এখন মাঝে মাঝে বাবলু বলেই ডাকি। কিছু কাজ করতে গেলে মনে হয় বাবলু এটা কিভাবে করত? একটা নতুন টি শার্ট কিনেছিলাম, গোলাপী রঙের, সেটা পরতে গিয়ে ভাবলাম, এই রংটা বাবলুর পছন্দ হত তো? বাবলুকে মানাতো? ঠিক বুঝতে না পেরে জামাটা সরিয়ে রাখি। এখন আমি রাস্তা ঘাটে, বাসে, ট্রেনে কান খাড়া করে থাকি। কেউ কাউকে ডাকলে বা কেউ কথা বললেই মনে হয় বাবলু বলে ডাকল নাতো? বা বাবলুকে নিয়ে কথা হচ্ছে না তো?  
 
যাইহোক, সাইটে ঢালাই হবে, আমার সেদিন নাইট ডিউটি। ইসমাইল চোস্ত মিস্ত্রি আছে, কোয়ালিটি সে দেখে নেবে, মাপ জোক ও নেবে, আমাকে মাঝে মাঝে ঘুরে আসতে হবে, বাকী সময় অফিস ঘরেই থাকবো, এমনি চাপ খুব নেই, কিন্তু পুরো দায়িত্ব আমার ওপর। তাই একটু টেনশন থাকবে, কিন্তু বিশেষ কিছু করার নেই, সবার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে, সবাই নিজের নিজের কাজ করবে, সবাই খুব অভিজ্ঞ, আমাকে একটু নজর রাখতে হবে শুধু। যাইহোক একবার রাউন্ড দিয়ে এসে ঘরে এসে বসেছি, আজ কাগজ পত্রের কাজ বেশি নেই, ঢালাই হয়ে গেলে একটু সই সাবুদ আছে, এখন একটু রিলাক্স টাইম। কি করি? আমি ঘরে ঢুকে টেলিফোন তা টেনে নিলাম। নাইট ডিউটি থাকলে আমার এটা একটা মজার খেলা। অজানা নং এ ফোন করে মানুষদের ঘুম চটকে দেওয়া। তারা রেগে যখন চীৎকার করতে থাকে আমার খুব মজা লাগে। আজও সেই ভাবে একটু টাইম পাশ করব ভেবেছি।  
প্রথম ফোন টা হল না। ওই নং এর কোন অস্তিত্বই নেই। ধুস কোন মানে হয়, খেলাটাই মাটি। পরের ফোনটা লাগলো। অনেকবার রিং হওয়ার পর একজন ধরল। আমি হ্যালো বলার আগেই, সে জড়ানো গলায় কি সব বলতে শুরু করল, আমি বুঝতেই পারলাম না।পুরো আকন্ঠ মদ খেয়ে আছে মনে হয়। আমি বোর করবো কি, সেই মাতাল লোকটি আমাকে পুরো বোর করে দিল। আজকের রাতটাই খারাপ। কি যে হবে, ঢালাই ঠিকঠাক হলেই হয়।
তিন নং ফোনের আগে একটু অপেক্ষা করলাম। সাইটটা একবার ঘুরেও এলাম, সব ঠিকঠাকই চলছে। কোন ঝামেলা নেই এখনও পর্যন্ত। এবারের ফোনের রিং খুব বেশি বাজলো না। ভীতু ভীতু গলায় একটা নারী কণ্ঠ গলাটা চেপে বলল, ‘হ্যালো’
আমিও বললাম, ‘হ্যালো’
মেয়েটির গলা এবার একটু শঙ্কিত মনে হল, আরোও একটু গলা চেপে বলল, ‘কে? কে বলছেন?’
আমার মনে কি এলো জানি না, বলে ফেললাম, ‘আমি বাবলু’
মেয়েটি একটু থমকে গেল যেন, ‘বাবলু? তুমি বাবলু?’
গলা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটির বয়স খুব বেশি হলে কুড়ি বাইশ হবে। একটু ফিস ফিস করেই কথা বলছে, মনে হয় বাড়ির লোকদের জাগাতে চায় না।
-‘হ্যা, আমি বাবলু’
এবার একটু ফোঁপানোর শব্দ পাওয়া গেল যেন।
-‘এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? কত খুঁজেছি তোমায়, কোথাও পাইনি জানো, কোথায় ছিলে তুমি, বাবলু?’
-‘কেন খুঁজেছ?’
-‘জানি না কেন খুঁজেছি। ফোন যখন করলে আরে কয়েকদিন আগে করতে পারলে না?’
-‘আগে করলে কি হতো?’   
-‘কি হতো জানি না’ । ফোনের ওপারে ফোঁপানোর শব্দ। আমি রাতে এত ফোন করে লোকের ঘুম ভাঙ্গিয়েছি, কেউ হুমকি দিয়েছে, কেউ ভয়ঙ্কর রেগে গেছে, গালাগাল দিয়েছে, কাঁচা, বাছা বাছা বিশেষণ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু কোন দিন এই রকম অবস্থার সামনে আসি নি। আমি কোন কথা খুঁজে পেলাম না, চুপই থাকলাম। 
-‘আমার তো নদিন আগে বিয়ে হয়ে গেল, বাবলু, দ্বিরাগমনে এসেছি, কালকেই চলে যাবো, কদিন আগে কেন ফোন করলে না, বলো বাবলু, বলো’
ফোনের ওপার থেকে বেশ জোরে চাপা কান্নার শব্দ আসছে, আমার আর কোন কথাই আসছে না, কি করব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা ক্রেডেলে রেখে দিলাম।
বাবলুর জন্য এবার আমার খুব কষ্ট হতে লাগল। 

শ্রাবণ ঘোষ
২৬/০৭/’২০

Comments

Science

Popular Posts

ভটচাজ সাহেব

এবার তোরা ত্রিশূল ধর

বাংলার তুল্য শ্রুতিমধুর আর কোন ভাষা!

কেমন আছো আকাশ

।। বৃত্ত টা কিন্তুু ছোটো হয়ে আসছে, আপনি সুরক্ষিত তো? ।।

ধসা বামুন

ছিদ্রান্বেষণ

1.দুইটি পরমাণুর ভর সংখ্যা একই হলেও, নিউট্রন সংখ্যা কম হয় কেন? নিউট্রন কেন আধান নিরপেক্ষ?

অহল্যা

চিঠি