অঙ্কের পরীক্ষা আর জীবনের পরীক্ষা, দু'টো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস... পরেরটায় অনেকক্ষেত্রেই, জিততে গেলে, আগে হারতে হয়!'

হার-জিত 

আজ থেকে ঠিক ২৪ বছর আগে রিক্সায় করে বাবার সাথে এসে নেমেছিলাম এই যায়গাটায়।

নামতে না নামতেই প্রশ্নবাণ - 'কি ছানা, পোনার নাম কি!'

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। শুনে অবশ্য এসেছিলাম, প্রশ্ন-টশ্ন করবে... বেশ কিছু উত্তরও রেডি ছিলো ঠোঁটের ডগায়। কিন্তু এটা তো পুরো ট্যানে গেলো! এক্কেবারে সিলেবাসের বাইরে... আকাশ-পাতাল ভাবছি, ছানার ডালনা আর পোনা মাছের কালিয়ার মধ্যে সম্পক্কোটা ঠিক কি হতে পারে!

আমার কাঁচু-মাচু মুখ দেখে প্রশ্নকর্তারা কি বুঝলো, বুঝলাম না! বোধায় ভাবলো, এতো মনে হচ্ছে, দুধে এখনো লেবুই টেপা হয়নি, ছানা তো দূরহস্ত! 

যাক্ গে! প্রশ্নটা দেখলাম নিজের থেকেই চেঞ্জ হয়ে এলো - 'বাড়ী কোথায়? এখানে সিনিয়ার কাউকে চিনিস?'

তখন বুঝলাম, ছানা হলাম গিয়ে আমরা, আর পোনা হলো পরিচিত সিনিয়ার, যে ছানাকে আগামী সাতদিনের লীলাখেলা থেকে আগলে আগলে রাখবে।

তা উত্তরে নেতিবাচক ঘাড় নাড়তেই, উল্টোদিকে দেখলাম একটা গুজগুজ ফিসফাস... 

আমার বাড়ীর লোকেশনে কম্পাস বসিয়ে, আগে-পরের দু'তিনটে স্টেশনের মধ্যে, যে সিনিয়ারদের বাড়ী রাডারে এলো, সেই হিসেবে, তিন মিনিটের মধ্যে আমার তিনজন পোনা তৈরী হয়ে গেলো! সঙ্গে সঙ্গে কোন্ হোস্টেলে, কোন্ উইং-এ থাকবো, সব সেট্...

ব্যাপারটা একটু কেমন-কেমন লাগছিলো! যা সব শুনে, ভয়ে ভয়ে এসেছিলাম, কিছুই তো মিলছে না! এতো দেখছি যাকে বলে, মেঘ না চাইতেই জল, সবই দু'য়ে-দু'য়ে কেমন আপনা থেকেই চার হয়ে যাচ্ছে!

তা ছানা-পোনা পর্ব সাঙ্গ করে, কলেজের দিকে এগোচ্ছি, আবার অন্য দু'জনের পাল্লায়... ততক্ষণে ভয়-ভয় ব্যাপারটা কেটে গিয়ে, মনের কোণায় একটা ছদ্ম আত্মবিশ্বাস উঁকি-ঝুঁকি দেবার চেষ্টা করছে...

একজন বাবার দিকে তাকিয়ে বললো - 'কাকু, কিচ্ছু চিন্তা করবেন না... আপনি এই অবধি পৌঁছে দিয়েছেন, বাকী ইঞ্জিনিয়ার করে আপনার কাছে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব আমাদের'...

তারপর বাবার সম্মতির অপেক্ষা না করেই, আমার দিকে তাকিয়ে -

- 'কিরে, ছানা! পোনা কে?'

বললাম... তিনজনেরই নাম...

- 'সেকি রে! লোকের একটা জোটে না, তোর তো দেখছি, তিন-তিনটে! তা উচ্চমাধ্যমিকে অঙ্কে কত পেয়েছিস?'

বললাম...

- 'বলিস কি! আমরা দু'জনে মিলেও তো অত নম্বর পাইনি... আর জয়েন্টে কত Rank?'

সেটাও বললাম...

- 'বেশ বেশ! এবার ধর, তোর Rank = [ x^y + y^x ] হলে, চট করে বলতো, x আর y কত হবে? দেখি অঙ্কের নম্বরটা তোকে ঠিকঠাক দিয়েছে কিনা!'...

ও হরি! এতক্ষণে মাথায় ঢুকলো, ওইসব খেজুরে প্রশ্নের পেছনের আসল উদ্দেশ্যটা কি!

উল্টোদিকে তখন 'দ্যাখ্ কেমন লাগে' মার্কা দেঁতো হাসি...

এমনিতে হয়তো আত্মসমর্পন করেই দিতাম, কিন্তু ওই কথায় বলে না, হারানো মাণিক আর আত্মবিশ্বাস, একবার ফিরে পেলে, আর সহজে হারায় না...

একটু চোখ বুজতেই, মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেলো, আর সেই কার্টুনে যেমন ভাবনার ক্লাউড দেখায়, ওরম একটা পেঁজা তুলোর মতো ক্লাউডে আমার উত্তরটা দেখতে পেলাম...

চট করে চোখ খুলে বললাম, 'x = 1 আর y = (Rank - 1)'...

ব্যাপারটা বোধায় প্রত্যাশিত ছিলো না... উল্টোদিকে তখন মুহূর্তের নিস্তব্ধতা... আর এটাকেই আমি ভীষণ ভয় পাই - ঠিক যেনো আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস...

তারপর যা হয় আর কি! সেই রামায়ণ, মহাভারতের যুদ্ধে যেমন ঝাঁকে ঝাঁকে তীর ছোটে, সেরকম প্রশ্নবাণ ছুটতে লাগলো - 'বল্! IIT এর সাথে T যোগ করলে কি হয়?'... '19 থেকে 1 বিয়োগ করে, কি করে 20 করবি?'... ইত্যাদি প্রভৃতি...

এর অধিকাংশই আগের থেকে জানা ছিলো! তাই আমার কোর্টে বল আসতেই, একটু চিন্তিত অভিনয়ের ভান করেই, সটান ফেরত...

আত্মবিশ্বাস আর উত্তেজনা দু'টোই তখন তুঙ্গে... আড় চোখে বাবার দিকে তাকাতেই, চমকে উঠলাম... বুঝলাম, বাবা কিন্তু এক্কেবারেই খুশী নয়...

আর ঠিক সেই সময়েই তিনি এসে উল্টোদিকের দলে যোগ দিলেন, এবং এসেই -

'কিরে ছানা! খুব নাকি অঙ্কে ফরফর করছিস... ডিফারেন্সিয়েশন জানিস?'

বাধ্য ছেলের মতো সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম...

একটা ইংরাজী শব্দ বলে বললো - 'এই শব্দটাকে "n" এর রেস্পেক্টে ফার্স্ট অর্ডার ডিফারেন্সিয়েশন করলে, কি হবে বলতো?'

আমি মনে মনে ভাবছি, এ আবার কিরকম প্রশ্ন, এতো জলের মতো সোজা... 'সাত কান্ড রামায়ণ শুনিয়ে, শেষে রাম কার ছেলে!'

উত্তরটা দিতেই যাবো, কিন্তু কেমন যেনো জিভে এসে আটকে গেছে... ঐ যে বলে না, 'পেয়ালায় চা আর মুখে চুমুকের মধ্যে বিস্তর ফারাক!'

ডিফারেন্সিয়েশন করে, উত্তরের শব্দটা যা দাঁড়িয়েছে, সেটা বাবার সামনে কিছুতেই উচ্চারণ করা যাবে না!

অগত্যা মাথা নীচু করে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম...

উল্টোদিকে তখন যেনো রাবনের দশটা মাথায়, হাসির অনুরণন হচ্ছে...

'কিরে! তোর অঙ্কের বেলুন তো পুরো চুপসে গেলো রে!... যা যা, জল্দি অ্যাডমিশন নিয়ে নে... আমাদেরও এখন ক্লাস আছে... সন্ধেবেলা হোস্টেলে আবার দেখা হবে!'...

তারপর সবকিছু ফর্মালিটি শেষ করে, হোস্টেলের রুমে যখন পৌঁছলাম, হঠাৎ বাবা বললো - 'তুই ঐ উত্তরটা জানতিস, তাই না!'

আমার তো তখন কান লাল হয়ে, গরম হয়ে গেছে... তবে কি, বাবা উত্তরটা জানে! কিন্তু বাবা তো কমার্সের প্রফেসর!

বুঝে উঠতে পারছি না, ঠিক কি বলবো... আর ঠিক তক্ষুনি বাবা যা বললো, সেটা আজও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি - 

'দেখলি! যতক্ষণ তুই মুখে মুখে উত্তর দিচ্ছিলি, ওরা তোকে আরো চেপে ধরছিলো, যেই একটা প্রশ্নে চুপ করে থাকলি, ওরা ছেড়ে দিলো... মনে রাখবি, অঙ্কের পরীক্ষা আর জীবনের পরীক্ষা, দু'টো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস... পরেরটায় অনেকক্ষেত্রেই, জিততে গেলে, আগে হারতে হয়!'...

অ.ব. | ২৬শে আগষ্ট, ২০২০

Comments

Post a Comment

Thank you, Stay connected & subscribe to this blog...

Science

Popular Posts

ভটচাজ সাহেব

এবার তোরা ত্রিশূল ধর

বাংলার তুল্য শ্রুতিমধুর আর কোন ভাষা!

কেমন আছো আকাশ

।। বৃত্ত টা কিন্তুু ছোটো হয়ে আসছে, আপনি সুরক্ষিত তো? ।।

ধসা বামুন

ছিদ্রান্বেষণ

1.দুইটি পরমাণুর ভর সংখ্যা একই হলেও, নিউট্রন সংখ্যা কম হয় কেন? নিউট্রন কেন আধান নিরপেক্ষ?

অহল্যা

চিঠি