সমাপ্তি ।

সমাপ্তি । 

ছোটো গল্পের শেষ দুটো পাতা নেই। পাঠাগার থেকে আনা বইটা আনকোরা নতুন না হলেও এক্কেবারে রদ্দি ছিল না। বছর পাঁচ পুরোনো পুজো বার্ষিকি । বোধহয় পাতা গুলো আলাদা হতে শুরু করেছিল , তাই নতুন করে বাঁধাঁনো ।হাতে পাওয়ার পর পুরোটা না শুখিয়ে যাওয়া আঁঠার স্পর্শ আর গন্ধও পেয়েছিল সবুজ । নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক, নতুন পুজো বার্ষিকি গুলো ইস্যু করা হতো না, পাঠাগারের লম্বা সারি দেওয়া বেন্চে বসে পরতে হতো । পুরোনো গুলো বাড়ি নিয়ে যাওয়া যেতো । তাই বছর পাঁচেক পুরোনো হলেও , প্রথম বার পড়া মানেই নতুন । 

খুব একটা নামী লেখকের গল্প নয় , কিন্তু গল্পটা জমেছিল দারুন । নায়ক ছোটো শহর , পুরোনো বান্ধবী আর ধারে ছাত্র পড়ানো ছেড়ে নতুন বডো শহরে যাবে কি যাবে না দোটানার মধ্যে পাতা দুটো উধাও । নিম্নমধ্যত্তদের টানাপোডেনের শেষ নেই , তার মধ্যে এই । শেষ না হওয়া ছোটো গল্প , মনটাই খারাপ হয়ে যায় সবুজের । আগে জানলে শুরুই করতো না গল্পটা । মনে খচখচানিটা রয়ে যায় ।

পড়ার ব্যচে সমাপ্তি কে ধরে সবুজ । সমাপ্তিরও বইয়ের দিকে টান আছে । “১৪০১ এর পত্রিকার রমেন স্যান্যালের পরিনতি গল্পটা শেষে কি হয় রে ?, ছেলেটা শহরে গেলো কি শেষ পর্যন্ত ? “ 

সমাপ্তির দৌড়ও ওই পাড়ার পাঠাগার পর্যন্ত । “১৪০১ টা পড়া হয়নি , মন্টু কাকু কে রেখে দিতে বলেছি । “ বডো অস্বস্তি বোধহতে থাকে সবুজের । নেহাতই একটা ছোটো গল্প , কিন্তু যতই ভাবতে থাকে , বিষয়টা মনে ঘুরতে থাকে । এদিকে লাইব্রেরিয়ান মন্টু কাকুকে জিগ্গেস করতেও ভরসা পাচ্ছে না, যদি ফাইন করে । যদি মনে করে সবুজ বই নষ্ট করে , পাতা ছিঁড়ে , অভিযোগ করতে এসেছে ! নিয়ম অনুযায়ী বই ইস্যু হওয়ার আগেই দেখে নেওয়া দরকার ।

আচ্ছা মনে মনে একটা পরিসমাপ্তি ধরে নিলেই তো হয়। দুটো তো উপায় , ট্রাজেডি নয়তো কমেডি। কিন্তু মন সায় দেয় না । পুরো পত্রিকার নামী লেখকদের গল্পকে পিছনে ফেলে , একটা অসমাপ্ত গল্প মন জুড়ে ঘুরতে থাকে । 

সৌম্যদের বাড়িতে একবার খোঁজ নেওয়া যাক , প্রতি বছর ওদের বাড়িতে আসে পুজোবার্ষিকি দুটো তিনটে । “নেই রে , মনে হয় ঠোঁংয়া হয়ে গেছে, কেজি দরে নিয়ে গেল গত রবিবার “ , সৌম্যর চটজলদি উত্তর আসে । সাধারন গল্পটা অগোছালো করে বলে শেষটা জানার চেষ্টা করে সবুজ । সৌম্যও মনে করতে পারে না , আদৌ গল্পটা পড়েছে কিনা । তেমন দাগ কাটার মতো কিছু নয় , শুধু অমিমাংশিত শেষটা কাঁটার মতো লেগে আছে গলায়। 

পাঠাগারে মন্টু কাকুর দারস্থ হয় শেষ পর্যন্ত । “রমেন সান্যালের কি কি বই আছে দাও তো “ । লেখকের নাম অনুযায়ী ক্যাটালগ করা খাতাটা এগিয়ে দেয় মন্টু কাকু । সাকুল্যে তিনটে বই ভদ্রলোকের , পাঠাগারে । ক্রমাংকো গুলো বলতেই নিয়ম অনুযায়ী সারিবদ্ধ তাক থেকে উদ্ধার হয় তিনটে বই । 

নেহাতই সাধারন মানের লেখক, তাই অব্যবহারে পড়ে ছিল তাকে । চাহিদাও নেই বইগুলোর। মন্টু মনে করতে পারে না , শেষ কবে বইগুলো ইস্যু হয়েছিল , বা আদৌ ইস্যু হয়েছিল কি না । হঠাৎ সবুজের এই বই গুলোই বা প্রয়োজন হল কেন , অবাক জিগ্গাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মন্টু সবুজের দিকে । পরিনতি.... পরিনতি...পরিনতি....সবুজ সুচিপত্র উল্টোতে থাকে , রুদ্ধশ্বাষে । তিন নম্বর বইয়ের সুচিপত্রের শেষ লাইনে আঙ্গুল থামে সবুজের । 

নাহ্ নেই । পরিনতির অপরিনতি । তাও তিনটে বই-ই বাড়ি নিয়ে আসে সবুজ । অনামি লেখকের প্রতি হঠাৎ আগ্রহ দেখে , আর এমনিতেও বইটির কোনো চাহিদা নেই বিচার করে , দুটোর জায়গায় তিনটে বইও দিয়ে দ্যায় মন্টু । 

গোগ্রাসে গিলতে থাকে সবুজ, যদি কোনো গল্পে একই ধরনের প্লট থাকে ! লেখকের মনস্তত্ত্বটা বুঝে কিছুটা যদি আন্দাজ করা যায় ! সৌম্য বলেছিল কলকাতার বইপাডায় নাকি ফুটপাতে পাওয়া যায় যেকোনো বই , কিন্তু সবুজের জীবন ছোটো শহরেই সীমাবদ্ধ । কেই বা শুনবে ওর কথা , তাওবা একটা শেষ না হওয়া গল্পের জন্যে । তিনটে বই শেষ হলেও যেখানে শুরু করেছিল , সেখানেই থমকে থাকে সবুজ । কোনো গল্পেই ছোটো গল্পের ছোঁয়া টুকুও নেই । 

রাতে শুতে যায় একই চিন্তা নিয়ে । গল্পের শেষটা বেয়াডা হয়ে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । মাঝরাতে বাজে স্বপ্নে ঘুম ভাঙ্গে । দুটো শব্দবন্ধ মনে পড়ে স্বপ্নের , পরিনতির সমাপ্তি আর সমাপ্তির পরিনতি । কোনো যোগসুত্র বের করতে পারেনা সবুজ। সমাপ্তি আর পরিনতি তো আক্ষরিক অর্থে একই , তবে দোটানাটা কোথায় ? 

একমাস পর , ছোটো শহরের বড় খবর হয়ে যায় সবুজ । এক্কেবারে আইআইটি , দিল্লি । মেদিনীপুরের বাইরে প্রথমবার পা রেখেছিল , ওই পরীক্ষা দিতেই , এবার সরাসরি দিল্লি যাত্রার জোগাড় । রাতে শোয়ার ব্যবস্থাযুক্ত ট্রেনে , না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয় সবুজ। কিছু নতুন না হওয়া জীবনে হঠাৎ একসাথে এতো কিছু নতুনের ধাক্কা সামলানো মুসকিল ।

“এই ভর সন্ধ্যে বেলায় আবার কোথায় বেরোচ্ছিস” - সমাপ্তির মার গলায় চিন্তার সুর । মেয়েটার মনটা ভালো নেই এমনিতেই , মুখফুটে বলতে হয়নি , টের পেয়েছেন । “যাই, লাইব্রেরির বই পাল্টাতে হবে” 
“দেখেশুনে যাস, দিনকাল ভালো নয়” 

“কাকু ১৪০১ এর পত্রিকাটা আছে ?” 

“এই তো নিলি মাস দেড়েক আগে , বাঁধিয়ে তুই প্রথম নিলি , তাই মনে আছে । আছে | আবার লাগবে !” মন্টুর গলায় বিষ্ময় । 

“আসলে , বাড়িতে দেখলাম দুটো পাতা খোলা পড়ে আছে , ঠি ক করে বাঁধানো হয়নি মনে হয় । আমি বাঁধিয়ে ফেরত দেবো । “

প্রথমবার অনেক কিছুই ঘটে , কিন্তু ২০ বছরের চাকরি জীবনে কেউ কোনোদিন স্পেশাল বাইন্ডিং খুলে যাওয়ার অভিযোগ করেনি । অনেক সময় কোনার লেখা চেপে গেছে বলে অনেকেই , কিন্তু বাঁধাইের বজ্র আঁটুনি , নৈব নৈব চ ! 

তবু কথা বাড়ায় না মন্টু , তাছাড়া নিজেইতো বললো বাঁধিয়ে দেবে । দিক । “ স্পেশাল বাঁধাই বলিস, পাঁচ টাকা বেশি নেবে।” 

সম্মতিসুচক ঘাড় নাডে , সমাপ্তি ।

ছোটোগল্পের নায়ক ছোটো শহর ছেড়ে বেরোতে পারেনি, তবুও গল্পটা বিয়োগান্ত নাকি মিলনান্ত , ঠি ক বুঋে উঠতে পারে নি, সমাপ্তি , দেড় মাস আগে ।

সবুজের দিন কাটতে থাকে , কলেজ assignment এর ভারে। তবুও মাঝে মধ্যেই একটা অসমাপ্ত স্বপ্ন ভাসে । কখনো ঘুমিয়ে, কখনো জেগে ।

Comments

Science

Popular Posts

ভটচাজ সাহেব

এবার তোরা ত্রিশূল ধর

বাংলার তুল্য শ্রুতিমধুর আর কোন ভাষা!

কেমন আছো আকাশ

।। বৃত্ত টা কিন্তুু ছোটো হয়ে আসছে, আপনি সুরক্ষিত তো? ।।

ধসা বামুন

ছিদ্রান্বেষণ

1.দুইটি পরমাণুর ভর সংখ্যা একই হলেও, নিউট্রন সংখ্যা কম হয় কেন? নিউট্রন কেন আধান নিরপেক্ষ?

অহল্যা

চিঠি