অঞ্জনা নদী তীরে চান্দনা গাঁয়ে
পড়ো মন্দির খানা গঞ্জের বাঁয়ে
"স্যার, গাঁ মানে তো গ্রাম | তাহলে গঞ্জ কাকে বলে ?" আমরা সমস্বরে জিজ্ঞাসা করি |
"গঞ্জ কাকে বলে জেনে কি তোদের দশটা হাত গজাবে? মা দুগ্গা হয়ে যাবি ? নে মুখস্থ কর !" প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাই কঞ্চির ছড়ি তুলে হুঙ্কার দেন |
আমরাও মুখস্থ করে ফেলি ছন্দের মাদকতায় | গঞ্জর মানে না জানলেও খঞ্জ হবার সম্ভানা নেই | কিন্তু জিজ্ঞাসা করে সপাৎ করে পায়ে ছাড়ির ঘা খেলে, দিন কয়েক খঞ্জ হবার সম্ভানা সমূহ |
তখন আর চিকে খেলতে কেউ দলে নেবে না | দূরে বসে খেলা দেখতে হবে | তাই গাঁ গঞ্জের অবোধ বালক, প্রাণের দায়ে TM মানে তেড়ে মুখস্থ করে |
TM এর জ্বালাও অবশ্য কাউকে না কাউকে ভোগ করতে হয় | আর সেটা হয় ক্লাসের সব থেকে নিরীহ প্রাণীটির | ভালো নাম বিভাস দণ্ডপাঠ | ঠাকুরদা আদর করে ডাকেন, "ভক্ত" |
আত্মীয় কেহ নেই নিকট কি দূর
আছে এক লেজকাটা ভক্ত কুকুর |
শুনলেই ভক্ত রেগে কাঁই | একদিন ঠাকুরদা এলেন মাস্টারমশাইদের কাছে নালিশ করতে, তাঁর আদরের নাতিকে নাকি সবাই কুকুর বলে |
দুর্বিনীত বালকগন বললো, "আমরা তো কবিতা পড়ছি | তাতে বিভাস রেগে যায় কেন?"
মাস্টারমশাই সহজ পাঠ দেখিয়ে ঠাকুরদাকে শান্ত করে |
বিভাস উল্টে ঠাকুরদার বকা খায়, "তোর জ্বালায় কি লোকে পদ্যও পড়বে না !"
"সব দিন তো আর সমান যায় না !" এই লাইনটা পড়িয়ে ক্লাস নাইনএ ভোলানাথবাবু একটু আপন মনে মুচকি হাসলেন | ভয়ডর বরাবরই আমার একটু কম |
তাই এমন গম্ভীর মানুষকেও জিজ্ঞাসা করে বসি,"স্যার, একটু পরেই তো প্রবল ঝড় উঠে, বেনের নৌকা বঙ্গপোসাগরে ডুবো ডুবো হবে, আর আপনি এই বিপদেও হাসলেন কেন ?"
স্যার বললেন, "একটা ব্যক্তিগত কথা মনে পড়ে গেলো | তাই হাসি রুখতে পারলাম না !"
আমাদের উৎসুক দৃষ্টি স্যার উপেকক্ষা না করতে পেরে, শুরু করলেন -
চাঁপাডাঙ্গার গঞ্জে আমাদের একটা পারিবারিক দোকান আছে | সন্ধ্যায় বসি | ওখানে পুরানো বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে গল্প গুজব হয় | আর দোকানের হিসাবটাও সেই ফাঁকে দেখে নিই |
আমাদের এক বন্ধুর একটা শ্যালো টিউব ওয়েল আছে | বোরো চাষের সেচের জল বিক্রি হয় | ঘণ্টা হিসাবে | প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওনার ছেলে এসে বাবাকে বলে যায় কত ঘন্টার কাজ হয়েছে | কোনো দিন বলে সাড়ে চোদ্দ ঘন্টা, তো কোনো দিন চোদ্দ ঘন্টা | মানে সব দিন ওখানেও সমান যায় না !
জিজ্ঞাসা করলাম, " এক দিন তো বারো ঘন্টার | তা কোনো দিন চোদ্দ, কোনো দিন সাড়ে চোদ্দ ঘন্টা হয় কি করে ?"
বন্ধু বললেন, "তোমার মাস্টারি মগজে এসব ঢুকবে না ! তবু শোনো, কারো হয়তো 35 মিনিট হলো, সেখানে লিখতে হরে ৪০ মিনিট | এভাবে সবার একটু একটু করে বাড়িয়ে দিলেই তো আরামসে চোদ্দ, সাড়ে চোদ্দ ঘন্টা হয়ে যায় !"
-"তাহলে প্রতি দিনই সাড়ে চোদ্দ ঘণ্টা হয়না কেন ?"
-"আরে আর বোলো না | আজকাল বিয়েতে অনেকেই ঘড়ি পাচ্ছে | আর ঘড়ি দেখে নিজেরাই বলে দেয় কত সময় হলো | সেখানে ৩৭ মিনিটকে বারো জোর ৪০ মিনিট করা যায় | তার বেশি নয় | তাই সব দিন সমান যায় না আর কি !"
স্যারের গল্প শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম | এর সঙ্গে আমার সেই পুরানো প্রশ্নটা চড়াং শব্দে চাগাড় দিয়ে উঠলো |
" স্যার, গঞ্জ মানে কি ? হাট ?"
স্যার বললেন, " ‘বক্সী গঞ্জে পদ্মা পারে’ হাট বসে বলে ? তাহলে তো মায়াপুর সব থেকে বড়ো গঞ্জ | সেখানে প্রতি রবিবার এই অঞ্চলের সব থেকে বড়ো হাট বসে | গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি কি বিক্রি হয় না ?"
-"স্যার তাহলে ?"
স্যার বললেন, " 'খড়ের আঁটি নৌকা বেয়ে/ আনলো ঘটে চাষার মেয়ে' | এখানেই কবিগুরু উত্তর দিয়ে গেছেন | গঞ্জ মানে নদী বন্দর, যেখানে মাহজানী নৌকায় দূর দূরান্ত থেকে বিভিন্ন সামগ্রী আসে এবং কেনা বেচা হয় | আমাদের চাঁপাডাঙ্গা ছিল তেমনই এক গঞ্জ | ৪০/৫০ এর দশকেও তেঁতুলতলার ঘটে এসে ভিড়তো বড়ো বড়ো মহাজনী নৌকা | বর্ধমানের আর হাওড়ার গ্রাম গঞ্জ থেকে আসতো ধান, পাট আরো অনেক কিছু | সেসব উঠতো এখানের আড়তে | সেই সব কৃষিপণ্য ন্যারো গেজের মার্টিন রেলে চেপে বড়গাছিয়া হয়ে পৌছাতো হাওড়া আর সেখান থেকে কলকাতা | তেমনি কলকাতার বিভিন্ন পণ্য রেল পথে আসতো চাঁপাডাঙ্গা আর সেখান থেকে মহাজনী নৌকা বোঝাই হয়ে পৌঁছে যেত বর্ধমান হাওড়ার বিভিন্ন গাঁয়ের গঞ্জে | এখন তো আর রেল নেই । লরিতে তাই বোঝাই হয় !”
আমি বললাম, "মার্টিন রেল আমরাও ছোট বেলায় দেখেছি | কয়লার গাড়ি |”
স্টিম ইঞ্জিনকে আমাদের ওদিকে কয়লার গাড়ি বলা হতো |
স্যার বললেন, "আর সেই মহাজনী নৌকা তোর বাবা দেখেছে তার ছোট বেলায় | সেও তো আমার ছাত্র ছিল | ডিভিসির বাঁধ হয়ে একদিকে যেমন বন্যা রোধ হলো, অন্যদিকে দামোদর নদী গেলো মজে | এখন কেবল বন্যার সময় কখনো সখনো সেই সব বড়ো বড়ো নৌকা দেখা যায় |"
সেই পালতোলা বড়ো বড়ো নৌকা আট দশ জন দাঁড় টেনে নিয়ে যেতে আমিও দামোদরে বন্যার সময় কয়েকবার দেখেছি | স্টিমার বা জাহাজ দেখার সুযোগ তখনও হয়নি | এক আকাশ বিষ্ময় নিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে দেখতাম |
হাওড়ার ব্রিজ প্রথম দেখি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয়ে | স্বচক্ষে দেখলাম হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিতে এসে | তখন আমাদের আরামবাগ তারকেশ্বরে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের কোনো সেন্টার ছিল না | দাদা তখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে MSc পড়ছে | থাকে বিডন রো এ কলকাতা উনিভার্সিটির হোস্টেল, পিজি হলে | আমার সিট পড়েছিল শ্যামপুকুরে | সেটা দাদার হোস্টেল থেকে ট্রামে কয়েটা স্টপ | আমি হেঁটেই মেরে দিতাম !
চাঁপাডাঙ্গাকে গঞ্জ কেন বলে না জানলেও, তার আকর্ষণ ছিল আমারকাছে অসীম | তেঁতুলতলায় বাবার মামার একটা মিষ্টির দোকান ছিল | সেই মিষ্টির আকর্ষণ অতিক্রম করা, বড়োই অনতিক্রম্য | তাই বাবার সাইকেলের রডে একদম ছিনে জোঁকের মতো চিপকে যেতাম |
বাবার সঙ্গে কোথাও যাবার আনন্দই আলাদা | সারা রাস্তা কত বিভিন্ন লোক বাবার সঙ্গে কথা বলতো | তারপর বাবা ওই লোকগুলোর কথা - তারা কে, কোথায় থাকে, কি করে, তাদের সঙ্গে বাবার কত স্মৃতি -সেই সব নিয়ে সারা রাস্তা গল্প করতেন |
তেঁতুলতলায় কাঠের বেঞ্চের সামনে স্বেতপাথরের টেবিল | প্লেটে করে মিষ্টি | হটাৎ একটা জোরে ভোঁওও |
বাবা বললেন, " ট্রেন এসে গেলো | এবার ভিড় হয়ে যাবে | তাড়াতাড়ি খেয়ে নে !"
ভিড় কেন বাবার ভালো লাগেনা ? কত ধরনের মানুষ | তাদের কত বিচিত্র সাজপোশাক, বিচিত্র কথাবার্তা আর তারথেকেও বিচিত্র তাদের লটবহর | আচ্ছা, ওই যে বড়ো বাকসোটা, ওর ভিতরে কি আছে ?
আমি খাওয়া ভুলে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকি | কত হৈচৈ, কত শব্দ, কত কথা উৎকর্ন্য হয়ে শোনার চেষ্টা করি | বাবা তাড়া দেন |
বাড়ি ফিরে দাদা বলে, "কতগুলো রসগোল্লা খেলি ?
-"তি-ন টে !"
-"মাত্র ! তুই বোকা | আমি হলে কমপক্ষে দশ বারোটা তো খেতামই |"
দাদা বরাবরই মিষ্টির পোকা | মিষ্টি না পেলে গুড়ের টিনে হাত ঢুকিয়ে গুড়ই চেটে চেটে খেত | আমি বরাবরই কম খাই | তবে খেতে ভালোবাসি |
দিদা বলতেন, "অন্কু আমাদের পেটুক না | তবে ভোজন রাসিক !"
চাঁপাডাঙাতে অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বাড়ি | অনেক খানি জায়গা নিয়ে | আর কি সুন্দর সুন্দর তাদের নাম | মাতৃ ভবন, বৃন্দাবন ইত্যাদি | তবে যেটা সবথেকে সুন্দর আর সবথেকে বড়ো তার নাম ছিল "পর্ণ কুটির " | কি সুন্দর নাম |
আমাদের যখন পাকা বাড়ি হলো, তার দরজায় চক দিয়ে আমিও লিখে দিলাম "পর্ণ কুটির " !
আলুর সব থেকে প্রধান বিপনন কেন্দ্র হিসাবে চাঁপাডাঙা আডে বহরে অনেক বড় হয়ে গেল । অনেক বড় বড় এবং সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরী হ’ল । দিন রাত জমজমাট বাজার !
তবে, সবদিন তো আর সমান যায় না !
বহুদিন লোকসানের বোঝা বইতে বইতে অবশেষে ১৯৭৩ সালের পয়লা জানুয়ারী মার্টিন রেল বন্ধ হয়েগেলো | কিছু রেল লাইনের অংশ, কিছু বাংলা চোরা রেলের বগির স্মৃতি ৮০র দশকেও দেখাযেতো | আজ আর তার কিছু নেই | বাবার মামার সেই মিষ্টির দোকানটাও আর নেই | তেঁতুল গাছহীন তেতুলতলার ঘটে আসেনা কোনো পালতোলা মাহাজনি নৌকো | পর্ণ কুটিরের সেই স্বেতপাথরের ফলকটাও আমাদের স্মৃতির মতোই কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেল |
নিশীথরঞ্জন অধিকারী
Comments
Post a Comment
Thank you, Stay connected & subscribe to this blog...