রাকেশ। ১৫ বছরের কিশোর। বন্ধুর সাথে নিজের ঘুমন্ত অবস্থার ছবি আপলোড করেছিল ফেসবুকে। তারপর কমেন্টের ফুলঝুড়ি। কেউ বলল 'হোমো', কেউ 'ছক্কা'। রেগে মেগে রাকেশ প্রতিবাদ করার চেষ্টা যত করল, ফল হল বিপরীত। আরও বাজে বাজে কমেন্ট পড়তে আরম্ভ করল। ভাইরাল হল পোস্ট। অপ্রস্তুত রাকেশের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল। বাবা মা জানতে পারলেন পরদিন ভোরে। রাকেশের নিথর শরীর দেখে। বাবার ক্যাবিনেট থেকে বের করে ঘুমের ওষুধের সব স্ট্রিপ খালি করে দিয়েছিল সে।
পূজা। দিল্লীর ১৩ বছরের কিশোরী। মায়ের কাছে ডেবিট কার্ড নাম্বার চেয়েছিল অনলাইনে কেনাকাটা করবে বলে। এক সপ্তাহ পর মা আবিষ্কার করলেন পূজার ওয়ার্ডরোবে অদ্ভুত সব শরীর দেখানো জামা কাপড় ও অন্তর্বাস। পূজার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে বেরিয়ে এলো আসল ঘটনা। দিনের পর দিন কম লাইক পেতে পেতে হতাশাগ্রস্ত পূজা একের পর এক শরীর দেখানো ছবি দিতে আরম্ভ করেছে। শুধু তাই নয়, পূজার ওয়ার্ডরোবে পাওয়া গেল মাদকদ্রব্য ও ঘুমের ওষুধ।
অথবা বিনোদ। তরতাজা ১৬ বছর। প্রেমে পড়েছিল যে মেয়েটির, সে উঁচু জাতের। স্কুলে সবার সামনে অপমান করে শান্তি হয়নি। ফেসবুকে পোস্ট করল ছবি দিয়ে - মুখটা দেখুন, পুরো বাঁদর। নিচে জাত তুলে পরপর কমেন্ট। বিনোদ নিতে পারেনি। আত্মহত্যা করল মজদুর বাবার সব স্বপ্নকে ভেঙে ফেলে।
সাইবার বুলিইং। সামাজিকভাবে কাউকে ভেঙে ফেলা। ব্যক্তিগত মূহুর্তের ছবি প্রকাশ করে দেওয়া। বন্ধুদের সামান্য মজা কিন্তু প্রাণঘাতী হতে পারে। হ্যাঁ, এটাই এখন ভারতে আত্মহত্যার একটি প্রধান কারণ। এবং আমার আপনার বাড়ির বাচ্চাটি এর শিকার কিনা আমরা এখনও জানি না। কোভিডের দৌলতে অনলাইন ক্লাস চলছে। সারাদিন মোবাইল, ল্যাপটপ, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বিরিয়ানি বানিয়ে ফেসবুক পোস্ট করছি। কিন্তু জানতে পারছি কি, এই জালের আড়ালে কেউ আমাদের সন্তানকে শিকার করছে কি না? হয়ত জানছি, কিন্তু দেরী হয়ে যাচ্ছে..
তথ্য বলে ভারতে ৮-১৬ বছর বয়সী ৮১℅ বাচ্চা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। এবং এদের মধ্যে ২২% সাইবার বুলিইংয়ের শিকার। বিশ্বে সর্বাধিক। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হল এর মধ্যে ৫২% বাচ্চা স্বীকার করেছে তারা কাউকে না কাউকে অনলাইন র্যাগিং করেছে। হ্যাঁ, আগে র্যাগিং মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন ইন্টারনেটের দৌলতে তা আমাদের বাড়িতেও ঢুকে পড়েছে। আজেবাজে ছবিতে ট্যাগ, গুজব রটানো, অপমানজনক মন্তব্য বা না জানিয়ে বাজে ছবি বা ভিডিও তুলে পোস্টিং - শিকারী শিকার খুঁজছে। যে করছে সেও জানে না অপরাধের গুরুত্ব, যার সাথে হচ্ছে সেও না জেনে অতলে তলিয়ে যাচ্ছে।
মিনিটের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে পোস্ট। গুটিয়ে যাচ্ছে বাচ্চারা ঘরের কোণে। হতাশা ছেয়ে যাচ্ছে। আর শেষে, পালিয়ে যেতে চাইছে এর থেকে। বন্ধুহীন, একা আমার আপনার সন্তান বলতে চাইছে অনেক কিছু। কিন্তু বলতে পারছে কি? সময় আছে আপনার হাতে? লক্ষ্য করছেন বেশ কিছুদিন ওর ক্ষিদে কমে গেছে। বাথরুমে বেশি সময় কাটাচ্ছে। কথা বলছে না ভালো করে। মেজাজ হারাচ্ছে। আর আপনি কী করছেন? বকা দিচ্ছেন। ঠেলে দিচ্ছেন আপনার সন্তানকে অন্ধকারে...
লাইক, কমেন্ট, শেয়ার। আপনার সন্তানকে এই রাস্তায় কে নিয়ে আসছে? কে দেখাচ্ছে লোভ? ৮৯% ভারতীয় কিশোর কিশোরী মনে করে তাদের ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করে ফেসবুকের ছবিতে কত লাইক পড়ল তার ওপর। ওর প্রথম গান, নাচ বা কবিতার ভিডিওটা কে আপলোড করেছিল? আপনি। এর থেকে বেরও করতে হবে আপনাকে। রাস্তা দেখাতে হবে আপনাকেই।
বন্ধু হন। সোশ্যাল নেটওয়ার্ককে ব্রাত্য রাখার যখন উপায় নেই, সাইবার বুলিইং নিয়ে বলুন আপনার সন্তানকে। অনলাইন সেফটি নিয়ে বোঝান। কোন পেডোফাইল যদি টোপ ফেলে তাহলে সে যেন বুঝতে পারে। আপনিও আইনের সাহায্য নিন। আপনার সন্তানকে বোঝান, সে একা নয়। আপনি আছেন তার সাথে। ওকে বলুন, লাইক, কমেন্টের বাইরেও একটা সুন্দর পৃথিবী আছে। রুখে দাঁড়াতে বলুন, সাহায্য করুন সাইবার বুলিইং এর বিরুদ্ধে।
তার থেকেও বড় কথা ওকে শেখান নিজেকে ভালোবাসতে। শেখান পরিবারের মূল্য, জীবনের মূল্য, বেঁচে থাকার মূল্য।ভালোবাসা। এর থেকে বড় কোন প্রতিরোধ নেই এই বেড়ে চলা অপরাধের প্রতি।
আজ আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসে, আসুন আমাদের সন্তানকে বিশ্বাস দিই, ভরসা দিই। একটা ফুলও ঝরে যেতে দেওয়া যাবে না....
Comments
Post a Comment
Thank you, Stay connected & subscribe to this blog...